ঘরটা পাকা হয়েছে। ঘরে আছে টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর ও বসার সোফা। বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। দৃশ্যত উন্নয়ন মানে তো এমন কিছুই কিংবা গ্রামের ধুলামাখা রাস্তাটি পাকা হয়েছে। বাজারটিতে উঠেছে পাকা দোকান, পাকা স্কুলঘর, কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা পোস্ট অফিস। আমাদের চোখে উন্নয়ন মানেই পোড়ামাটির স্থাপনা, ইটের ভবন। যত বেশি উন্নয়ন- তত বেশি প্রয়োজন ইট, কাঠ, পাথর। কিন্তু এই ইট পোড়াতে খরচ হয়ে যাচ্ছে জ্বালানি হিসেবে প্রকৃতির গাছ। ইট তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে কৃষিজমির মাটি। সর্বোপরি ইটভাটার আশপাশের কৃষিজমি হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত।
পাঠক, আপনাদের হয়তো কুব্বাত হোসেন অভির কথা মনে থাকতে পারে। সাভারের হেমায়েতপুরের দক্ষিণ মেটকা ডাক্তারবাড়ি এলাকায় তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা কুব্বাত হোসেন অভি। বয়স ৩৭-৩৮ বছরের বেশি হবে না। সাভারে প্রায় ৫০ বিঘা জমির ওপর তার স্বপ্নের চাষবাস। না, দেশীয় কোনো সবজি নয়। সেখানে আবাদ হচ্ছে ক্যাপসিকাম, চেরি, টমেটো, ক্যাবেজ, রেডবিট, সেলেরি, চায়নিজ ক্যাবেজ, বেবিকর্ন, সুইটকর্ন, নিরা লিফ, ব্রোকলিসহ নানা রকমের বিদেশি সবজি। ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেঁষে বিস্তর তার কৃষির জগৎ। মনে পড়ে- বছর পাঁচেক আগে যখন প্রথমবার তার কৃষি খামার দেখতে যাই, তার কৃষিক্ষেতগুলো ছিল সবুজ। কিন্তু গত জানুয়ারিতে গিয়ে দেখি কেমন ধূসর হয়ে আছে তার সব ফসলের ক্ষেত। এমন কেন হলো বুঝতে দেরি হলো না। অদূরেই দুটি বিশাল ইটের ভাটা। ইট পোড়ানোর ধোঁয়া উড়ছে। কুব্বাত বলছিলেন, মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। ফসলের আকারও আগের মতো বড় হচ্ছে না। ইটভাটার ক্ষতিকর প্রভাব টের পাচ্ছেন। কুব্বাতের অধিকাংশ জমিই লিজ নেওয়া। ধীরে ধীরে বড় করেছেন তার কৃষি খামার। কিন্তু এখন আর বড় করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ইটভাটার আশপাশের অধিকাংশ জমির ওপরের মাটি কেটে নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। মাটির ওপরের অংশ অর্থাৎ ‘টপ সয়েল’ ইট তৈরির কাজে ব্যবহার হওয়ায় কৃষি ও পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
২০১৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব থেকে জানা গেছে, সারাদেশে ইটভাটা ছিল ৪ হাজার ৯৫৯টি। আর পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের হিসাব জানায়, দেশে ইটভাটার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯০২টি। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণায় উঠে এসেছে ৫০ শতাংশ ইটের ভাটাই অবৈধ। একটি ইট তৈরিতে মাটির প্রয়োজন হয় ৪ কেজি। বছরে প্রতিটি ইটভাটা থেকে ২০-২৫ লাখ ইট উৎপাদিত হয়। একটি সূত্র মতে, দেশের ইটভাটাগুলোয় বছরে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি ইট প্রস্তুত হয়। এত ইট তৈরি করতে গিয়ে কৃষি জমিগুলো কী পরিমাণ মাটির ওপরিভাগ হারাচ্ছে, তা নিশ্চয়ই অনুমান করা কঠিন কিছু নয়।
মাটির ওপরিভাগের ৫ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত যে স্তর, সেটিকে বলা হয় টপ সয়েল। এটিই হলো মাটির প্রাণ। এতে জৈব পদার্থ ও অণুজীবের সর্বাধিক ঘনত্ব থাকে। ফলে মাটির উর্বরতা মূলত এ অংশেই। আর এ অংশেই ফসল উৎপাদিত হয়। অনেকেই লোভে পড়ে টপ সয়েল বিক্রি করে দিচ্ছেন। কোনো কৃষক টপ সয়েল বিক্রি করে দেওয়ার পর পাশের জমির কৃষকও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নানাভাবে। জমি উঁচু-নিচু হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানিতে ওপরিভাগের মাটি ধুয়ে চলে যাচ্ছে।
গত মাসে একই সমস্যার কথা বলছিলেন মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার জার্মিতা গ্রামের কৃষকরা। তারাও জানান, ইটভাটার কারণে তাদের কৃষিজমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। ফসল ভালো হচ্ছে না। বাতাস দূষিত হচ্ছে বলে শ্বাসকষ্টের মতো অসুখে ভুগছেন বয়স্করা। এ চিত্র শুধু সাভার কিংবা মানিকগঞ্জের নয়, সারাদেশেই নির্বিঘ্নে চলছে পরিবেশবিধ্বংসী ইটভাটার কার্যক্রম। কোথাও কোথাও নিয়মবহির্ভূতভাবে আবাসিক এলাকাতেও ইটভাটা গড়ে ওঠার খবরও পাওয়া যায়।
যতদূর জানি, পোড়া ইটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব ব্লক ব্যবহারের একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের সরকারি নির্মাণে এই ব্লক ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু সরকারি অবকাঠামো নির্মাণে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নে চোখে পড়ছে না তেমনভাবে। ইটের পরিবর্তে ব্লক ব্যবহারের চমৎকার একটি উদাহরণ হচ্ছে ভাসানচরের রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রকল্প। যতটা জানি, এ প্রকল্পের সব নির্মাণকাজে পোড়া ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লকের ব্যবহার করা হয়েছে। হাউস অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট জানায়, রাস্তাঘাট বা ভবনের দেয়ালে পোড়া ইট ব্যবহার না করে এসব কাজে ব্লক ব্যবহার করা উচিত। ব্লক তৈরি করতে তারা ব্যবহার করেছেন নদীর তলদেশের মাটি ও বালু। আমরা জানি, আমাদের অধিকাংশ নদীই নাব্যতা হারিয়েছে। নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন। এতে যেমন নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব, তেমনি আবার ড্রেজিংয়ে পাওয়া নদীর তলদেশের মাটি ব্লক তৈরিতেও ব্যবহার করা সম্ভব। জানা মতে, দেশের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ব্লক তৈরি শুরু করেছে। বিশেষ করে বেসরকারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কনকর্ড, সেল ও বিটিআই নির্মাণকাজে ব্লক ব্যবহার করছে। সরকার চাইলে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে পারে। এতে একসঙ্গে দুটি উপকার হবে। নদীগুলো ধীরে ধীরে নাব্যতা ফিরে পাবে। পরিবেশবিধ্বংসী পোড়া ইট উৎপাদনও কমে আসবে এবং পরিবেশ দূষণ কম হবে।
স্বাধীনতার সময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি। আর এখন ১৭ কোটি ছাড়িয়েছে। এ মাটিতেই উৎপাদিত হয়ে আসছে আমাদের সবার খাদ্য। এই অধিক ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে মাটির ওপর আমরা মাত্রা অতিরিক্ত অত্যাচার করে এসেছি। জমিতে প্রয়োগ করতে হচ্ছে রাসায়নিক সার। অধিক কর্ষণে মাটি হারাচ্ছে উর্বরতা, নষ্ট হচ্ছে জৈবগুণ। আবার সময়ের সঙ্গে বেড়েছে আমাদের ফসল বৈচিত্র্যও। তার পর মাটির ওপরিভাগ ইট তৈরির জন্য ব্যবহার করে নিজেদের পায়েই কুড়াল বসাচ্ছি।
মাটির সুস্থতাই নিশ্চিত করে সুস্থ ফসলের তথা নিরাপদ খাদ্যের। আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে টেকসই কৃষির তাগিদে আমাদের এখন থেকেই মাটির সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। টপ সয়েলের যত্ন নিতে হবে। এর পাশাপাশি কৃষককেও মাটির স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করতে হবে। ভারসাম্যপূর্ণ সারের ব্যবহার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কৃষককে আরও সচেতন করে তুলতে হবে। বিশেষ করে মাত্রা অতিরিক্ত সারের প্রয়োগ, সুষম মাত্রা ও ব্যবস্থাপনা অনুসরণ না করায় যেসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাদের সচেতন করে তোলাটা বেশি জরুরি। অন্যদিকে মাটিদূষণের অকৃষিজ কারণগুলো চিহ্নিত করে তা নিরোধের পদক্ষেপ নিতে হবে। ইটের ভাটা কৃষিজমির যে ক্ষতি সাধন করছে, তা রোধ করতে হবে এবং নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ।
শাইখ সিরাজ : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
Leave a Reply