নদী বা খাল বিলের মাছ হিসাবে পরিচিত অনেক মাছ এখন বাজারে বেশ চোখে পড়ে, দামও তুলনামূলক কম। এক সময় বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়লেও বিজ্ঞানীদের চেষ্টায় এসব মাছ আবার খাবারের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে।
জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক প্রতিবেদন দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২০ প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে এখন বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। সামনে রয়েছে চীন ও ভারত।
ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পুকুরে মাছ চাষে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।
এই সাফল্যের পেছনে রুই, কাতলা, তেলাপিতা, সরপুটিঁর মতো মাছের চাষাবাদে উন্নত জাত উদ্ভাবন যেমন রয়েছে, তেমনি ভূমিকা রেখে দেশের নদ-নদীর মাছের কৃত্রিম চাষাবাদ পদ্ধতি।
বাংলাদেশের মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিলুপ্তপ্রায় ও দেশীয় ৩১টি প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে শাকুর আহাম্মদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘যেসব মাছ বিলুপ্তি বা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে, সেগুলো রক্ষা করতে অনেকদিন ধরেই আমরা এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট কাজ করছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া গেছে। বিশেষ করে দেশীয় অনেকগুলো প্রজাতির কৃত্রিমভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব হয়েছে।’
তিনি জানান, নদী থেকে প্রথমে মাছ সংগ্রহ করে কৃত্রিমভাবে বদ্ধ জলাশয়ে অভ্যস্ত করে তোলা হয়। হরমোন প্রয়োগ করে এসব মাছের প্রজনন ঘটানো হয়। পরবর্তীতে সেসব মাছের পোনাকে নানা প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম পরিবেশের বা বদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত করে তোলা হয়। এভাবে নদ-নদীর মাছগুলোকে আস্তে আস্তে চাষের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
নদ-নদীর যেসব মাছ এখন চাষ করা হচ্ছে:
টেংরা মাছ
আইইউসিএন এর ২০১৫ সালের তালিকা অনুযায়ী, টেংরা বাংলাদেশের বিলুপ্তির ঝূঁকিতে থাকা মাছ। তবে বর্তমানে এই প্রজাতির মাছের কৃত্রিম প্রজনন, পোনা প্রতিপালন, চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পর মাঠ পর্যায়ে চাষাবাদও শুরু হয়েছে।
বৈরালি মাছ
এটি উত্তরবঙ্গের একটি জনপ্রিয় সুস্বাদু মাছ। সেখানে এটি বরালি বা খোকসা নামেও পরিচিত। খাল, বিল, পাহাড়ি ঝর্ণা, অগভীল স্বচ্ছ নদীতে এই মাছটি পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের সৈয়সদপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা রংপুরের চিকলি নদী ও দিনাজপুরের আত্রাই নদী থেকে বরালি মাছ সংগ্রহ করে উপকেন্দ্রের পুকুরে কৃত্রিমভাবে চাষাবাদ করেন। ২০২০ সালে তারা প্রথমবারের মতো বরালি মাছের কৃত্রিম প্রজনন ঘটাতে সক্ষম হন।
গত বছর থেকেই উত্তরবঙ্গে এটি কৃত্রিমভাবে চাষাবাদ শুরু হয়েছে।
বাটা ও ভাঙ্গন মাছ
রুই, কাতল বা কার্প জাতীয় মাছের পাশাপাশি এই দুটি জাতের মাছ বর্তমানে চাষ করা হচ্ছে। এসব মাছ সহজেই পুকুরের পানিতে খাপ খাইয়ে নেয় এবং স্বাভাবিক খাবার খেয়ে বড় হয়। ফলে একসময় নদ-নদী বা বিল-হাওড়ের মাছ বলে পরিচিতি থাকলেও এখন এটি অনেকটা সহজলভ্য মাছ হয়ে উঠেছে।
বালাচাটা মাছ
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলভেদে এ মাছটি পাহাড়ী গুতুম, গঙ্গা সাগর, ঘর পইয়িা, পুইয়া, বাঘা, বাঘা গুতুম, তেলকুপি নামেও পরিচিত। উত্তরবঙ্গে এটি বালাচাটা, পুইয়া নামে বেশি পরিচিত। একসময় উত্তরবঙ্গে এই মাছটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেলেও এখন কমে এসেছে। ২০১৯ সালে এই মাঝের কৃত্রিম প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশর মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট।
গুতুম মাছ
বাংলাদেশের প্রায় সব নদ-নদী, খাল-বিল বা জলাশয়ে এ মাছটি পাওয়া যায়। এটি গুটিয়া, গোরকুন, পোয়া, পুইয়া নামেও পরিচিত। মাছটিরও প্রজনন কৌশল আবিষ্কার করার পর এখন চাষাবাদ শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এর ফলে এই মাছের বিলুপ্তির ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।
খলিশা মাছ
এটি বাংলাদেশের পরিচিত একটি দেশীয় মাছ। খৈলশা, খৈইলা নামেও এই মাছটি পরিচিত। তবে বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্রে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এই মাছের প্রাচুর্যতা ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে।
ফলে এ প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং চাষাবাদের জন্য পোনা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট ২০১৮ সালে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন শুরু করে।
কুচিয়া
বাংলাদেশে কুচিয়া তেমন জনপ্রিয় মাছ না হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে এর অত্যন্ত চাহিদা রয়েছে। আগে প্রকৃতি থেকে ধরে কুচিয়া বিদেশে রফতানি করা হতো।
২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা কুচিয়ার কৃত্রিম প্রজনন ঘটাতে সক্ষম হন। ফলে প্রকৃতির বদলে কুচিয়াকে চাষের প্রচলিত খাবারে অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে। কৃত্রিমভাব পোনা উৎপাদন করায় এখন প্রাকৃতিক পরিবেশের বদলে কুচিয়ার চাষাবাদ হচ্ছে এবং রফতানি হচ্ছে।
ঢেলা
ঢেলা নদীর একটি মাছ। এই মাছে প্রচুর খনিজ পদার্থ থাকে। দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠায় বাজারে মাছটি বেশ উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়।
২০২০ সালে ব্রহ্মপুত্র নদ ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকে ঢেলা মাছের পোনা সংগ্রহ করে তা পুকুরের পানির সাথে খাপ খাওয়াতে নিবিড় প্রতিপালন করা হয়। এই সময় এর খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ এবং সেই অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয়।
হরমোন প্রয়োগের মাধ্যমে ঢেলা মাছের কৃত্রিত প্রজনন ঘটাতে সক্ষম হন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট ময়মনসিংহ শাখার বিজ্ঞানীরা।
ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, যেহেতু প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে, এখন এর পোনা উৎপাদন ও প্রাপ্যতা সহজতর হবে। ফলে ঢেলা মাছকে সহজেই চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। তখন এর বিলুপ্তির ঝুঁকি যেমন কমবে, তেমনি দামও কমে যাবে।
পিয়ালী মাছ
যমুনা ও পদ্মা নদীর মানুষের কাছে পিয়ালী একটি পরিচিত ও জনপ্রিয় মাছ। এক সময় এই দুই নদীতে এ মাছটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেলেও এখন সেই সংখ্যা কমে এসেছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের সান্তাহার উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা যমুনা, বাঙ্গালী ও আত্রাই নদী থেকে পিয়ালীর পেনা সংগ্রহ করে তা পুকুরে প্রতিপালন করেন। পরবর্তীতে তাদের খাদ্যাভ্যাস পর্যালোচনা করে সেইরকম খাবার দেয়া ও হরমোন প্রয়োগ করে কৃত্রিম প্রজনন ঘটাতে সক্ষম হন। এখনো এটি নিয়ে গবেষণা চলছে।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, তাদের এই গবেষণায় সাফল্য পাওয়া গেলে আর চাষ শুরু হলে মাছটি আবার সবার জন্য সহজলভ্য হয়ে উঠবে।
কাকিলা মাছ
কাইকা বা কাকিলা নামের মাছটি অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের অন্যতম মাছ। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এই মাছের বিপুল চাহিদা থাকলেও উৎপাদন অনেক কমে গেছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের যশোরের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি মাছটির কৃত্রিম প্রজনন ও বদ্ধ পরিবেশে অভ্যস্ত করণে সাফল্য পেয়েছেন। এরপর পোনা উৎপাদন শুরু হলে বাংলাদেশের পুকুর বা বদ্ধ জলাশয়ে বাণিজ্যিকভাবে এই মাছের চাষাবাদ করা যাবে বলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন।
রাণী মাছ
স্বাদু পানির বিলুপ্তপ্রায় মাছের মধ্যে অন্যতম একটি মাছ রাণী মাছ। খুব সুস্বাদু মাছটিকে বেটি, পুতুল বা বেতাঙ্গী নামেও ডাকা হয়। এটি মূলত খাল-বিল, হাওড়-বাওড় এবং নদ-নদীর মাছ। তবে আইইউসিএনের ২০১৫ সালের তালিকায় মাছটি বিপন্নপ্রায় মাছের তালিকায় রয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট ২০২১ সালের জুন মাসে এই মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করতে পেরেছে। এখনো এটি নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে গবেষকরা আশা করছেন, কৃত্রিম চাষাবাদে মাছটি অভ্যস্ত হয়ে গেলে দেশের সর্বত্র পুকুরে এই মাছের চাষাবাদ করা সম্ভব হবে।
বাটা ও টাটকিনি
নদী, ঝর্ণা, খাল, বিল ও হাওড়ের মাছ হলেও দুটি মাছ এখন পুকুরে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। টাটকিনির কৃত্রিম প্রজনন সম্ভব হয়নি। ফলে নদী বা প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে চাষাবাদ করা হয়।
তবে নদীর মাছ হলেও হ্যাচারিতে বাটা মাছের রেণু উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। ফলে সম্প্রতি চাষীদের কাছে এই মাছের চাষ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
মহাশোল
মাছটি পাহাড়ি নদী বা ঝর্ণার একটি মাছ। তবে মাছটি একেবারেই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। যেসব স্থানে এই মাছ পাওয়া যেতো, সেখানেও মাছটি এখন খুব বেশি দেখা যায় না।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মহাশোল মাছের কৃত্রিম প্রজননের চেষ্টা করছেন।
কোরাল ও ভেটকি
কোরাল ও ভেটকি মূলত সমুদ্র মোহনা ও উপকূলের মাছ। তবে বিজ্ঞানীরা মাছটিকে এখন খাচা আকারে চাষাবাদের চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষক, ড. শফিকুর রহমান বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, কুতুবদিয়ায় কয়েকটি খাঁচা আকারে তারা এই মাছের চাষাবাদের চেষ্টা করছেন। সাগরের পানিতে থাকায় মাছটি প্রাকৃতিক পরিবেশ পাচ্ছে, আবার বাইরে থেকে খাবার দেয়ায় তারা যথেষ্ট খাবার পেয়ে দ্রুত বড় হয়ে উঠছে।
তিনি আশা করছেন, এভাবে সফলতা পাওয়া গেলে মাছটিকে উপকূলবর্তী এলাকায় ব্যাপকভাবে চাষ করা যাবে। তখন যেমন সুস্বাদু এই মাছ সহজলভ্য হয়ে উঠবে, তেমনি দামও কমে যাবে।
তবে উপকূলীয় জেলাগুলোয় অনেকে প্রকৃতি থেকে পোনা সংগ্রহ করে ঘের আকারে ভেটকি ও কোরালের চাষ করছেন।
যেসব মাছ দীর্ঘদিন ধরে কৃত্রিমভাবে চাষাবাদ হচ্ছে:
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলছেন, বাংলাদেশের দেশীয় মৎস্য উৎপাদনে দেশীয় ছোট মাছের অবদান ৩০-৩৫ শতাংশ। এসব মাছের চাহিদা বেশি থাকায় চাষাবাদও দিনে দিনে বাড়ছে।
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা প্রাপ্তি সহজলভ্য হওয়ায় এর মধ্যেই হ্যাচারিতে বা কৃত্রিম পদ্ধতিতে পাবদা, গুলশা, শিং, মাগুর,আইড়, চিতল, রাজপুটি, মেনি, দেশি সরপুটিঁ, কালিবাউশ, গজার, টেংরা ও কৈ মাছ ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে।
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত এক দশকে ছোট মাছের উৎপাদন চারগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে এই মাছের উৎপাদনের পরিমাণ যেখানে ছিল ৬৭,০০০ মেট্রিক টন, সেখানে ২০১৮ সালের উৎপাদন ছিল প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply