ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের যোগাযোগ সহজ করতে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) নাকি সেতু বিভাগ কোন সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে এ নিয়ে চলে টানাটানি। সওজ প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ করে সমীক্ষা করে। এটি বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত হয় এ রুটে হাইস্পিড ট্রেন চালু করতে হবে। ১১০ কোটি ১৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে হাইস্পিড ট্রেনের সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইনে।
সওজ ও রেল দুই সংস্থা মিলে ২১০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। বিনিয়োগকারীর অভাব দেখিয়ে হাইস্পিড ট্রেনের প্রকল্পটি অনিশ্চয়তার খাতায়। এবার সওজের অধীনে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে করা হবে। এ চিন্তায় দুটি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক বিবেচনায় এ রুটে এক্সপ্রেসওয়ে করা দরকার ছিল। তা বাদ দিয়ে কেবল চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এক্সপ্রেওয়ে করলে এর সুফল খণ্ডিত আকারে মিলতে পারে। মূল করিডর বাদ দিয়ে এ ধরনের চিন্তাকে কারিগরি জ্ঞানের অভাব হিসাবে দেখছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগে এক্সপ্রেসওয়ে জরুরি। উদ্যোগটি বাতিল করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। হাইস্পিড ট্রেনের সিদ্ধান্ত ভুল সেটি বুঝতে সমীক্ষার দরকার নেই। এখন চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেসওয়ে করার কথা বলা হচ্ছে। এটিও দরকারি। পর্যটন, এনার্জি হাব থেকে শুরু করে নানা কারণে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার আগে তো রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামে এক্সপ্রেসওয়ে করা দরকার। বরং ঢাকা-মাওয়ার আগেই চট্টগ্রাম রুটে এক্সপ্রেসওয়ে করা উচিত ছিল। এখন এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সুযোগ পর্যাপ্ত আছে কি? ওই মহাসড়ক ধরে অবকাঠামো নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় দেড়শ কিলোমিটার এলাকা ধরে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হবে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার করিডোরের মধ্যে ট্রাফিক জেনারেশনের উৎস নিয়ে কাজ চলছে। গভীর সমুদ্রবন্দর, এনার্জি হাব, ট্যুরিস্ট জোন ইত্যাদি বিবেচনায় স্টাডি করা হচ্ছে। বিবেচনায় রাখা হয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন, মেরিন ড্রাইভ সড়ক, আনোয়ারা-বাঁশখালী-চকরিয়া সড়ক। জাপানের সহযোগিতা সংস্থা জাইকার মাধ্যমে স্টাডি চলছে। পাশাপাশি বুয়েটের মাধ্যমেও স্টাডি করা হচ্ছে। জাপানের মাধ্যমে সরকারি পিপিপির অর্থায়নে বাস্তবায়নের চিন্তা রয়েছে। এ জন্য জাইকার স্টাডি টিম কাজ করছে। পাশাপাশি বুয়েট কাজ করছে পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়নের পূর্বধাপ হিসেবে।
এ বিষয়ে সওজের সংশ্লিষ্ট প্রকল্প তদারক কর্মকর্তা শ্যামল কুমার ভট্টাচার্য বলেন, জাইকার মাধ্যমে ইন্টারসেকশনের কাজগুলো করা হবে। ৫টি বোটলনেক সমাধানের কাজ চলছে পৃথক প্রকল্পের মাধ্যমে। বাকি অংশ এক্সপ্রেসওয়ে হিসেবে নির্মাণ হবে। এ জন্য জাইকার টিম কাজও করছে। বুয়েটের মাধ্যমেও পৃথক স্টাডির কাজ চলমান।
ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান যানবাহনের চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। সময় বাঁচাতে তাই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সওজ। ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দেয়। এর পর সমীক্ষা পর্বসহ নানা ধাপ সম্পন্ন হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে আসে সেতু বিভাগের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের ধাপ। সওজের মাধ্যমে প্রকল্পটি অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ায় মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে সেতু বিভাগ অবশ্য পরে পিছু হটে। পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের রেজিস্ট্রেশন অব ইন্টারেস্ট আহ্বান এবং ভিজিএফ (ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং) চূড়ান্তকরণও সম্পন্ন হয়। এর কিছুদিন পর যখন নির্মাণকাজের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা, তখনই ঘোষণা আসে প্রকল্প বাতিলের। অথচ এসব কাজে সময় গেছে ৮ বছর; ব্যয় হয়েছে একশ কোটি টাকা। এর পর সিদ্ধান্ত আসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বুলেট ট্রেন চালুর। বর্তমানে এ পথে যাতায়াতে অন্তত ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। হাইস্পিড তথা বুলেট ট্রেন চালু হলে সময় লাগবে মাত্র ৫৫ মিনিট। দ্রুতগতির এ ট্রেন চালু করতে খরচ পড়বে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের এ অর্থ খরচ করে রেলওয়ের জন্য প্রকল্প কতটি বাস্তবসম্মত হবে এমন প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। এরই মধ্যে সরকারের ১১০ কোটি ১৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে হাইস্পিড ট্রেনের সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইনে। হাইস্পিড ট্রেন চলাচলে রেলের সক্ষমতার পাশাপাশি বিনিয়োগের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও সম্ভাব্যতা নিয়ে কথা হয়।
একজন যাত্রীকে হাইস্পিড ট্রেনে যাতায়াতে কিলোমিটারে ১০ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। সে হিসাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে খরচ পড়বে প্রায় ৩ হাজার টাকা। প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব বলে সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়। ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে বুলেট ট্রেন। বিরতিহীনভাবে চললে এ ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছতে সময় নেবে ৫৫ মিনিট। স্টপেজ ধরলে সময় লাগবে ৭৩ মিনিট। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের অধিকাংশই উড়ালপথ। পিক আওয়ারে ১৬টি কোচে ১২০০ আসন আর অফপিক আওয়ারে ৮টি কোচে ৬০০ আসনে যাত্রী পরিবহন হবে বুলেট ট্রেনে। যদিও এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পথ থেকে সরে আসছে রেল। তার কারণ বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করে এ প্রকল্পে আগ্রহী মিলছে না। একই বিষয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি পিপিপি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের প্রস্তাব ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ সিসিইএ সভায় নীতিগত অনুমোদন হয়। এর পর সমীক্ষা পরিচালনা এবং বিশদ নকশা প্রণয়ন করা হয়। পরে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ না করে বিদ্যমান ফোরলেনবিশিষ্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রশস্তকরণ এবং উভয় পাশে পৃথক সার্ভিস লেন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এসব বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে হবে; ভিন্ন আদলে। আরও দুই লেন বাড়ানো হবে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত জাপানের সহযোগিতায় জিটুজি পিপিপি পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন হবে। টোল নেওয়া হবে। এ জন্য যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকবে। তাই সেখানে ‘এক্সপ্রেসওয়ে’ নাম থাকবে।
সূত্র বলছে, যাত্রী পরিবহনে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে হাইস্পিড ট্রেন চালুর কথা; এটি এখন বাতিল প্রকল্প। আর সওজের অধীনে এক্সপ্রেসওয়ের পরিবর্তে মহাসড়ক বর্ধিত করা হবে। তবে এক্সপ্রেসওয়ে হলে যাত্রীসহ পণ্য পরিবহনের সময় সাশ্রয় হতো। কারণ রাস্তার ধারে বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনার কারণে মহাসড়কে যানজট হয়। মাঝখান দিয়ে জলে গেল রেল ও সওজ-এর স্টাডি বাবদ ২১০ কোটি টাকা।
Leave a Reply