কোনো ফৌজদারি মামলায় জড়ালে আসামিকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হয়। তবে এটাও স্বাভাবিক যে, সুনির্দিষ্ট অপরাধ করেও অপরাধী বলতে চায়, সে ‘নির্দোষ’। সেটা হোক তদন্তের সময়, কিংবা বিচারে।
অন্যদিকে কোনো মানুষ যদি দোষ বা অপরাধ না করেও মামলার জালে আটকা পড়েন তাকেও নির্দোষ প্রমাণের জন্য প্রাণপণ লড়াই করতে হয়। সেটা কজন জানেন? কত জনের খবর আসে গণমাধ্যমে? কতজন সঠিক তদন্ত বা ন্যায়বিচার চেয়ে কোর্ট-কাছারি বা সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন? এমন প্রশ্নের সরল উত্তরটাও জটিল।
বাস্তবতা হচ্ছে- সবাই লোক ধরতে পারেন না। আবার হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে যার সহযোগিতা পাওয়া যাবে, ওই পর্যন্ত যেতেও পারেন না। তার কি মুক্তি মেলে? তিনি কি দীর্ঘ ভোগান্তির জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন? এই যুক্তিগুলো সামনে রেখে ন্যায়বিচারপ্রত্যাশী হাসান মজুমদার নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের হওয়া একটি মামলার দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে।
ঘটনা : ৬ নভেম্বর ২০১৬।
হাসানকে আটকের সময় দুপুর ১২টা ২৭ মিনিট। ঘটনাস্থল পুরানা পল্টন, হোটেল বন্ধু আবাসিকের রিসেপশন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, হাসান ও তার সঙ্গে সোহেল নামে আরেক যুবককে সাদা পোশাকের ৫ জন লোক আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। এর পরের ঠিকানা মিন্টো রোড।
চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার প্রসন্নকাপ গ্রামের মজুমদারবাড়ির মো. আবদুুল হাই মজুমদারের ছেলে মো. হাসান মজুমদার। তিনি হোটেল বন্ধু আবাসিকের ম্যানেজার। অপরজন ওই হোটেলের বাবুর্চি সোহেল রানার বাড়িও হাসান মজুমদারের পাশের গ্রামে।
মিন্টো রোডে নেওয়ার পর কী ঘটে- এমন প্রশ্নে হাসান মজুমদার জানান, আটকের ১৭ ঘণ্টা পর তাদের দুজনকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়। তাদের আটকের সময় যদিও কোনো ওয়ারেন্ট ছিল না ওই ৫ জনের কাছে। ১৭ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে হাসানের চোখ ভারী হয়ে আসে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা ২৫ (ক) ধারায় রুজু করা মামলার আসামি হাসান ও সোহেল। আর মামলার বাদী ইন্সপেক্টর তপন কুমার ঢালী। মামলার ভাষ্য অনুযায়ী অপরাধ- হাসানের কাছ থেকে ২০ লাখ ও বাবুর্চি সোহেল রানার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকার জাল নোট উদ্ধার।
ঘটনার পেছনের ঘটনা : হাসান মজুমদার ও সোহেল রানাকে আটক করা হয় ৬ নভেম্বর ২০১৬, দুপুর ১২টা ২৭ মিনিট। যা ওই হোটেলের তিনতলা ও নিচ তলায় সিঁড়ির সামনের সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা আছে। অথচ মামলার এজাহারে বাদী বলেন, ‘বিকাল অনুমান ৪টা ১৫ মিনিট (১৬.১৫) গোপনে সংবাদপ্রাপ্ত হই যে, মতিঝিল থানাধীন ফকিরাপুল মাছবাজারের পশ্চিম পাশের গলিপথের ওপর কতিপয় অজ্ঞাতনামা লোকজন জাল টাকা ক্রয়-বিক্রয় করার জন্য অবস্থান করিতেছে। উক্ত সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সঙ্গীয় অফিসার ফোর্সসহ ১৬.৩০ (৪.৩০) ঘটিকায় উল্লেখিত স্থানে পৌঁছামাত্র আমাদের উপস্থিতি টের পাইয়া কতিপয় অজ্ঞাতনামা লোকজন পালানোর চেষ্টাকালে অফিসার ও ফোর্সের সহায়তায় ২ জনকে ধৃত করি। বাকিরা পালিয়ে যায়।’
কিন্তু বাস্তবতা কী? সিসি ক্যামেরার ফুটেজ কী বলে? এই লেখার বিশ্লেষণে পুরো বিষয়টি খোলাসা করে দেখা যায় আসল ঘটনা কী?
প্রসঙ্গ ঘটনাস্থল ও সময় : সিসি ক্যামেরার তথ্য বলছে, হাসানসহ দুজনকে দুপুর ১২টা ২৭ মিনিটে পল্টনের বন্ধু হোটেল থেকে আটক করা হয়। অপরদিকে এজাহারের তথ্য বলছে, বিকাল সাড়ে ৪টায় তাদের ফকিরাপুল মাছবাজার থেকে জাল টাকাসহ ধরা হয়।
ব্যত্যয় : বাস্তবতা, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও আটকের স্থানের ঘটনার কোনো মিল নেই। ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক, তথ্যগত অসঙ্গতি, ভুল তথ্য কিংবা ঘটনাস্থলের বর্ণনার ঘাড়তির ফলে মামলাটি এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। মামলা থেকে হাসানসহ দুজনকে অব্যাহতি দেওয়া যেত; কিন্তু তা করা হয়নি।
চার্জশিট : এজাহারে উল্লেখ করা হাসান ও সোহেলের বিরুদ্ধে মামলাটির তদন্ত চলে ৯ মাস। ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর একই ধারায় তাদের দুজনের নাম জড়িয়ে চার্জশিট দাখিল করা হয়। চার্জশিটে ২৫ লাখ টাকার জাল নোটের তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘উপরোক্ত আসামি হইতে প্রতিটি সিরিজের দুই পিস করে নমুনা আলামত রাখি। বাকি আলামত শপিংব্যাগসহ আদালতের আদেশে ধ্বংস করা হয়।’
প্রশ্ন : আলামত ধ্বংস করার (পোড়ানো) সময় একজন ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত রাখার বিধান থাকলেও সেটি অনুসরণ করা হয়েছে কিনা?
জাল টাকার আলামত পোড়ানো বা ধ্বংস করার যে বর্ণনা চার্জশিটে দেওয়া হয়েছে, তা-ই বা কতটুকু সত্য? কারা ছিলেন সেই পোড়ানো ঘটনার সাক্ষী? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে মূল ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। হাসান ও সোহেলকে হোটেল থেকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় জাল টাকা বা শপিংব্যাগের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তা হলে আটকের পর তারা জাল টাকা কোথায় পেলেন? কে তাদের জাল টাকা সরবরাহ করলো- এই প্রশ্নটিও বড় আকারে দেখা দিয়েছে।
মামলার এজাহার ও চার্জশিট পর্যালোচনায় যে সারাংশ পাওয়া যায় তাতে স্পষ্ট যে, হাসান ও সোহেলের কাছ থেকে আদৌ কোনো জাল টাকা জব্দ বা উদ্ধার করা হয়নি। ফকিরাপুলের গল্পটা যে সাজানো, তা প্রমাণের জন্য বেশিদূর যেতে হবে না। এই মামলাটিকে মিথ্যা মামলা দাবি করে মামলার ন্যায় তদন্তসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য হাসান ডিএমপি কমিশনারের কাছে আবেদন করেন হাসান। এর পরিপ্রেক্ষিতে গুলশান বিভাগের প্রশাসন ক্যান্টনমেন্ট (জোন) অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সাহেদ মিয়াকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা এডিসি মোহাম্মদ সাহেদ মিয়া তার মতামত কলামে চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরেন। তাতে তিনি বলেন, ‘অত্র ঘটনায় হাসান মজুমদারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় উল্লেখিত গ্রেপ্তারের স্থান ও তার কাছ থেকে জাল টাকা উদ্ধারের বিষয়টি আমার প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ হয়নি।’ অর্থাৎ মামলার চার্জশিট দাখিলের প্রায় তিন মাস পর এডিসি সাহেদ মিয়ার অনুসন্ধান প্রতিবেদনে আসল সত্য বেরিয়ে আসে। অথচ তার আগেই ওই বছর ১৯ সেপ্টেম্বর হাসানকে জাল টাকার ব্যবসায়ী বানিয়ে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (ক) ধারায় আদালতে চার্জশিট দেন ডিবির এসআই দেওয়ান উজ্জ্বল। তার তদন্তে কেন সত্য তুলে ধরা হলো না সে এক বিস্ময়।
হাসানের বিরুদ্ধে বিচার শুরু : ডিবি পুলিশের মামলা ও চার্জশিটের ওপর ভিত্তি করে ২০১৮ সালের ফেব্রæয়ারির দিকে হাসান ও সোহেলের বিরুদ্ধে চার্জগঠন শুনানি হয়। আসামিপক্ষ থেকে ঘটনার প্রকৃত বিবরণ, এডিসি সাহেদ মিয়ার প্রতিবেদন ও সিসি ক্যামেরার ফটোসহ প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। কিন্তু সরকারপক্ষের পাবলিক অতিরিক্ত প্রসিকিউটরের আপত্তির মুখে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হাসানসহ দুজনের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুনানি শুরু করা হয়। অর্থাৎ হাসানের আবেদন, নিবেদন, হাহাকার কোনো কিছুই কাজে আসেনি। মামলাটির বিচার চলছে চার বছর ধরে। যদিও হয়রানির সূত্রপাত আরও দুই বছর আগে ২০১৬ সালে।
হাসানের জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া ছয়টি বছর : সেই যে শুরু তখন থেকে গ্রেপ্তার, রিমান্ড, জেল খাটা, মামলার পেছনে দৌড়ানো, আদালতে হাজিরা দেওয়া, হয়রানিমূলক মামলা থেকে রেহাই পেতে পুলিশ প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘোরা- আর কত দিন, কত মাস, কত বছর চলবে? কেন এমন রহস্যময় মামলার পেছনে হাসান কিংবা সোহেলকে বছরের পর বছর ধরে এভাবে দৌড়াতে হচ্ছে। ৬ বছরে মামলার পেছনে লড়তে গিয়ে হাসান নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তার গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে দিয়েছেন। সংসার চালাতে গিয়ে তিনি আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। হোটেলের চাকরির মাসিক বেতন দিয়ে তিনি মামলায় হাজিরা দেন। আইনজীবীর ফি দেন। দায়-দেনায় জর্জরিত হাসান জানেন না আর কত দিন তাকে এই মামলার ঘানি টানতে হবে।
হাসানের প্রশ্ন, আমাকে এই হয়রানিমূলক মামলায় আর কত দুর্ভোগ পোহাতে হবে? তিনি জানান, তার বিরুদ্ধে মামলার বিচার চলছে। ওই মামলা থেকে নিষ্কৃতি চেয়ে তাকে মামলায় জড়িয়ে যারা হয়রানি করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও তিনি তদন্ত দাবি করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরসহ ১০টি প্রতিষ্ঠানে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা ও জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে পৃথক ৭টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে; কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।
কেন এই হয়রানিমূলক মামলা- এমন প্রশ্নে হাসান মজুমদার বলেন, সাদা পোশাকে কয়েকজন লোক বন্ধু আবাসিক হোটেলে গিয়ে ক্যাশ চেক করেন। ক্যাশে তখন ঢাকাস্থ কচুয়া উপজেলা সমিতি ও হোটেলের নগদ টাকাসহ ৫ থেকে ছয় লাখ টাকা ছিল। ক্যাশ চেক করে এবং হাসানকে আটকে জড়িত টিমের দুজন। তারা কোনোভাবে ক্যাশ থেকে টাকা সরাতে চেয়েছিল বলে আমার ধারণা; কিন্ত আমি বিষয়টি বুঝে ফেলায় ক্যাশে তালা মেরে দিই। এ কারণে তারা ক্ষোভে জোর করে কাউন্টার থেকে আমাকে ধরে নিয়ে যায় বলে আমি মনে করি। আটকের পর ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পর এক কনস্টেবল ও এক এএসআই আমার কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করেন; কিন্তু আমি কীভাবে টাকা দেব। তখন তারা ক্যাশের চাবি চান। আমি বলি মালিকের টাকা। আমাকে হিসাব দিতে হবে। তখন তারা বলেন, আপনি আগে বাঁচুন। তারা সুবিধা না পেয়ে মামলায় ফাঁসিয়ে দেন বলে আমি মনে করছি। গ্রেপ্তারের পর হাসান ৫ মাস ১৭ দিন কারাভোগ করে জামিন পান; কিন্তু ঝামেলা আর পিছু ছাড়ছে না। হাসান এই ভয়ানক হয়রানির মামলা থেকে অব্যাহতিসহ জড়িতদের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে উচ্চ আদালতের সহায়তা চান।
Leave a Reply