দরিদ্র দেশগুলোকে ঋণ দিয়ে চীনা সরকার সেসব দেশে প্রকৃত উন্নয়নের পরিবর্তে দেশগুলোকে ‘বিপদের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে’ বলে বিশ্বব্যাপী সমালোচনা শুরু হয়েছে। তবে চীন সে অভিযোগ বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছে। চীন এখন বিশ্বের একমাত্র একক বৃহৎ ঋণদাতা দেশ। প্রকাশ্য ঋণের অঙ্গীকার সত্ত্বেও চীনের অপ্রকাশিত বিপুল ঋণ রয়েছে বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এইডড্যাটা বলছে, চীনা ঋণের একটি বড় অংশই প্রকাশ করা হয় না কিংবা পরিসংখ্যানে আসে না। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া কলেজ অব উইলিয়াম অ্যান্ড মেরির একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা ‘এইডড্যাটা’র বিশ্লেষণ অনুসারে, পৃথিবীর ১৬৫ দেশের মধ্যে চীনাদের ৮৪৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ১৩ হাজার ৪২৭টি চীনা উন্নয়ন প্রকল্প কাজ করছে।’
কিছু বৈদেশিক ঋণ প্রায়ই চীনা সরকারি ব্যালান্সশিটে বরাবরই উহ্য থাকে। বিদেশী সরকারের সাথে চীনা সরকারের ঋণ দেয়া-নেয়ার পরিবর্তে চীন ঋণগুলো দেয় সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি, ব্যাংক, যৌথ অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। এইডড্যাটার তথ্যানুসারে, পৃথিবীতে ৪০টি নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশ রয়েছে যেগুলোকে তাদের জিডিপির ১০ শতাংশ ঋণ দেয়া হয়েছে ‘হিডেন ডেট’ হিসেবে। জিবুতি, জাম্বিয়া, রিপাবলিক অব কঙ্গো, নাইজার, লাওস, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনেগ্রো, কিরগিজিস্তানের মতো দেশগুলোকে তাদের জিডিপির ২৫ শতাংশের সমপরিমাণ ঋণ দিয়েছে চীন। ঋণের বেশির ভাগই প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) তহবিল থেকে রোড, রেলওয়ে, বন্দর, খনিজসম্পদ উত্তোলন শিল্পে দেয়া হয়েছে।
চীনের পাশের ছোট কিন্তু সম্পদশালী দেশ লাওস তার সার্বভৌমত্ব একরকম হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে। লাওসের ‘ন্যাশনাল ইলেকট্রিক পাওয়ার গ্রিড’ কোম্পানি ঋণ শোধ করতে না পেরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘চায়না সাদার্ন পাওয়ার গ্রিড’ কোম্পানির কাছে ৬০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে। চীনা ঋণ চুক্তি সংশোধন করতে চায় উগান্ডা সরকার। উগান্ডার একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিতে উগান্ডা সরকারের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে চীনা ঋণকে ‘পুনর্বিন্যাস’ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। মাদাগাস্কারে চীনারা বিনিয়োগ করেছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সেখানেও একই অবস্থা। ঋণ শোধ না করতে পারার একটি প্রবণতা কাজ করছে। ইতোমধ্যে মাদাগাস্কারের নতুন সরকার চীনাদের সাথে কয়েকটি চুক্তি যেমন- মাছ ধরার যে চুক্তি, তা বাতিল করেছে।
ঋণ শোধ করতে না পারায় চীনা সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দরের দায়িত্বভার নিয়ে নিয়েছে।
শ্রীলঙ্কার কাছে চীনের ১০০ কোটি ডলারের (এক বিলিয়ন ডলার) ঋণ রয়েছে। জিবুতি নামক আফ্রিকার ছোট দেশ; তার বন্দরও চীনাদের নিয়ন্ত্রণে। জিবুতির এই বন্দরে আবার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। এ ব্যাপারে মার্কিন অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের (৬ ফেব্রæয়ারি ২০১৮) মন্তব্যটা এমন ছিল- বেইজিং অস্বচ্ছ চুক্তি, শিকারিদের মতো ঋণ অনুশীলন এবং দুর্নীতির সুযোগসমেত চুক্তি করে ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর ঋণের ওপর নির্ভরতাকে উৎসাহিত করে। চীন ঋণভারে জর্জরিত করে ঋণগ্রহীতাদের সার্বভৌমত্বকে বিপদাপন্ন করে তাদের দীর্ঘমেয়াদি টেকসই প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। আফ্রিকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনা ঋণ কাজ করছে এটা ঠিক কিন্তু চীন যেভাবে সেখানে ঋণ বিতরণ করছে যে, সে দেশগুলো শেষ পর্যন্ত ঋণফাঁদে পড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকেই চীনের এই প্রক্রিয়াটিকে, ‘ঋণের ফাঁদ কূটনীতি’ বলছেন। এর মাধ্যমে খুব সস্তায় অবকাঠামো নির্মাণের লোভনীয় প্রস্তাব থাকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত গ্রহীতা দেশগুলো সুদসহ মূল ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে ব্রিটেনের বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা এমআইয়ের প্রধান রিচার্ড ম্যুর বলেছিলেন, “চীন অন্যান্য দেশের উপর নিজের উদ্দেশ্য সাধনে বা অন্যান্য দেশের উপর প্রাধান্য বিস্তার করার জন্য ‘ডেট ট্র্যাপ’ বা ঋণের ফাঁদ ব্যবহার করে থাকে।” চীন এমন শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে যে, সময় শেষে ঋণের অর্থ শোধ করতে না পারলে সে দেশের সম্পদের নিয়ন্ত্রণ চীনাদের হাতে ছেড়ে দিতে হয়। সমালোচকরা শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের উদাহরণ দিয়ে থাকে। হাম্বানটোটায় চীনা বিনিয়োগে বিশাল বন্দর প্রকল্প শুরু হয়েছিল। কিন্তু চীনা ঠিকাদাররা ঋণ নিয়ে প্রকল্পটিকে বিতর্কের মধ্যে ফেলে দেন এবং শ্রীলঙ্কা পড়ে ঋণের ফাঁদে। শেষতক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে শ্রীলঙ্কা হাম্বানটোটা বন্দরের ৭০ শতাংশ ৯৯ বছরের জন্য চীনাদের হাতে তুলে দিয়েছে বন্ধক হিসেবে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউজ দাবি করেছে, ‘স্থানীয় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় শ্রীলঙ্কার সাথে চুক্তিটি করা হয়েছিল এবং চীন আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই এই বন্দরের মালিকানা গ্রহণ করেনি। এই বন্দরের জন্য দেয়া ঋণের একটি বিশাল অংশ চীনাদের নয়।’ চ্যাথাম হাউজ বলছে, ‘চীন সরকার এই বন্দরকে ব্যবহার করে কৌশলগত সামরিক সুবিধা নিয়েছে এমন প্রমাণ এখনো মেলেনি।’ এটা ছাড়া অনেকেই বলছেন, বিগত বছরগুলোতে চীনা অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা শ্রীলঙ্কায় বেড়েছে এবং অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এই অঞ্চলে চীনের রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষাকে এগিয়ে নিতে ব্যবহার করা হতে পারে।
শ্রীলঙ্কার মতো ঠিক একই রকমভাবে বিশ্বের অন্যান্য অংশে চীনা ঋণগুলো বিতর্কের মধ্যে পড়েছে। চীনারা ঋণের চুক্তিগুলো এমনভাবে করে থাকে যে, শেষ পর্যন্ত ঋণ ব্যবহার করে দেশগুলো সময়মতো শোধ করতে না পারলে সে দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ চীনকে দিয়ে দিতে হয়। এখানে আরেকটি বিষয় হলো- চীনারা বিদেশে ঋণবিষয়ক বেশির ভাগ তথ্য প্রকাশ করে না। ঋণগ্রহীতা দেশকেও শর্ত দিয়ে থাকে যে, ‘তারা যেন কোনো তথ্য প্রকাশ না করে’। এটাও ঠিক, আন্তর্জাতিক ঋণ চুক্তিতে গোপনীয়তা একটি সাধারণ বিষয়। গোপনীয়তা অবলম্বন করতেই হবে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পেতে হলে এই রেওয়াজটাই চালু আছে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে চীনারা বৈদেশিক উন্নয়নে অর্থায়ন করে বাণিজ্যিকভাবে এবং গোপনীয়তার সাথে। তবে বেশির ভাগ শিল্পোন্নত দেশ যারা প্যারিস ক্লাবের সদস্য, তারা বিদেশী সরকারকে যে অর্থ ধার দেয় তা প্রকাশ করে থাকে। চীন প্যারিস ক্লাবের সদস্যও হতে চায় না।
পশ্চিমা ঋণদাতা দেশগুলোর চেয়ে চীন উচ্চ সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। বিশ্বব্যাংকের চেয়ে চারগুণ বেশি চড়া সুদে (৪ শতাংশ হারে) চীনা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাওয়া যায় তবে সহজ শর্তে। অপর দিকে, চীনাদের ঋণ ১০ বছরের কম সময়ের মধ্যে শোধ করে দিতে হয়; কিন্তু পশ্চিমা ঋণদাতারা ঋণ শোধ করতে প্রায় ২৮ বছর সময় দিয়ে থাকে। চীনা ঋণে গ্রেস পিরিয়ডও কম থাকে। অন্য দিকে, অফশোর ব্যাংকিংয়ে একটি ন্যূনতম ব্যালান্স রাখতে হয় কোনো দেশকে চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির ঋণ পেতে হলে এবং এই অ্যাকাউন্টে চীনা কোম্পানির প্রবেশগম্যতা থাকতে হয়। এ ব্যাপারে এইডড্যাটার নির্বাহী পরিচালক ব্্রাড পার্কস বলছেন, ‘কোনো ঋণগ্রহীতা দেশ ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হলে চীনারা একটি বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে (মন্দঋণ হিসেবে তা সংগ্রহ না করে) ঋণগ্রহীতা দেশের ওই অফশোর অ্যাকাউন্ট থেকে ঋণের টাকাটা তুলে নেয়।’ পশ্চিমা দেশের ঋণদাতা দেশগুলোর মধ্যে এই প্র্যাকটিস দেখা যায় না বললেই চলে।
গত দুই দশকে চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ দিয়েছে। ২০১৩ সালে ‘বিআরআই’ নামক প্রকল্পটি বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। চীনের সাথে বাকি বিশ্বকে যোগ করে নেয়ার জন্যই এই বড় প্রকল্পটি নিলেও বিশ্বে চীনাদের প্রভাব বাড়ানোই এর মূল লক্ষ্য বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন।
এইডড্যাটার গবেষণা অনুসারে, বিদেশে চীন বছরে ৮৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে যা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের দ্বিগুণ। বিআরআই শুরুর পর থেকে প্রতি একটি মঞ্জুরির বিপরীতে চীন ৩১টি ঋণ দিয়েছে বলে এইডড্যাটা বলছে।
এইডড্যাটা বলছে, চীনা অর্থ বিনিয়োগের এই প্রক্রিয়াটি খুবই অস্বচ্ছ। যেখানে বিনিয়োগ করা হোক না কেন, সে বিনিয়োগের যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। জাম্বিয়ায় এ ধরনের বিনিয়োগের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে চীনারা এই অভিযোগটিকে কখনোই স্বীকার করে না, প্রত্যাখ্যান করে আসছে। প্রত্যাখ্যান করলেও ঋণগ্রহীতা দেশগুলো সময়মতো ঋণ শোধ করতে না পারলে জামানত হিসেবে চীন যে, সেসব দেশের সম্পদ জব্দ করে থাকে তার উদাহরণ অনেক। যুক্তরাষ্ট্রের সিএনবিসি নিউজ, চীনের লন্ডন ও ওয়াশিংটন দূতাবাসে এইডড্যাটার রিপোর্টের ওপর মন্তব্য করার জন্য যোগাযোগ করা হলে কোনো উত্তর চীনা দূতাবাসের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি।
Leave a Reply