কর্মসূচি আর প্রকল্পের ছড়াছড়ি। কর্মকর্তাদের টেবিলে টেবিলে বিশাল কর্মযজ্ঞের ফাইলের স্তূপ। কিন্তু মাঠের চিত্র ভিন্ন। সেখানে বাসা বেঁধেছে লাগামহীন দুর্নীতি। অযত্ন-অবহেলায় ধুঁকছে অনেক প্রতিষ্ঠান। চলছে অর্থ লোপাট। প্রকল্পে নয়ছয় তো আছেই। বিপরীতে সমাজসেবার সেবাদানে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে ‘দারোগাগিরি’ ছড়ি। যুগান্তরের সপ্তাহব্যাপী অনুসন্ধানে যার যৎসামান্য বেরিয়েছে মাত্র। যদিও বাস্তবে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার শেকড় আরও গভীরে। যে কারণে এ প্রতিষ্ঠানে যাদের চাকরির বয়স যত বেশি, তাদের অনেকের সম্পদের পাহাড়ও তত বেশি। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানের ঘুসের চরকিতে পা রেখে ঢাকা শহরে আলিশান বাড়ির মালিকও বনে গেছেন। বেছে নিয়েছেন বিলাসী জীবন। দীর্ঘ অনুসন্ধান এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের শক্ত হাত পড়লে খবরের পেছনের খবর বের হতে বেশি সময় লাগবে না।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির বিষয়ে মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলামের বক্তব্য জানার চেষ্টা করে যুগান্তর। এ জন্য সোমবার ডিজির কার্যালয়ে গেলে ব্যক্তিগত কর্মকর্তার মাধ্যমে মহাপরিচালক জানান, তিনি ‘নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বক্তব্য দিতে পারছেন না।’ বুধবার সকালে তার মুঠোফোনে প্রথমে কল করা হয় এবং পরে এসএমএস দিয়ে বক্তব্য চাওয়া হয়। কিন্তু এতেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে বুধবার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহফুজা আখতার এর বিষয়ে যুগান্তরকে সময় দেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের বেহাল অবস্থার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রণালয় জিরো টলারেন্সের নীতিতে এগোচ্ছে। এজন্য বিভাগীয় মামলাগুলো নিষ্পত্তি’র উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ এবং খাবারের ওপর কঠোর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু আছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়মিত মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করছেন।’ তবে তিনি দাবি করেন, ‘এখানকার প্রতিটি কর্মী দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাই গণমাধ্যমের কাছে তার প্রত্যাশা থাকবে-মন্দ কাজের গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি ‘ভালো কাজের প্রশংসাও থাকতে হবে। তা না হলে যারা সত্যিই সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন তারা হতাশ হবেন।’
ভিক্ষুক প্রকল্পে ৩ কোটি : সমাজসেবা অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পে খরচ হয় ৩ কোটি টাকা। অথচ প্রকল্প সফল হয়নি। ভাসমান ভিক্ষুকদের আটক করে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হলেও পালিয়ে যান তারা। ফলে ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প থেকে সরে গেছে অধিদপ্তর। মাঝখানে গচ্চা গেছে সরকারের বিপুল অংকের টাকা। সরেজমিনে দেখা যায়, মিরপুর-১ নম্বরে অবস্থিত ভবঘুরে আশ্রয় কেন্দ্রে এক সময় ভিক্ষুকদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এখন সেটি ব্যবহৃত হচ্ছে অভ্যর্থনা কেন্দ্র হিসাবে। ভবনটি পরিত্যক্ত। ১৫ ডিসেম্বর দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের পরিবেশ অনেকটাই পোড়োবাড়ির মতো। তিন তলা একটি জরাজীর্ণ ভবনে বেশ কয়েকজন শিশু, কিশোর এবং কিশোরীকে রাখা হয়েছে।
হঠাৎ অপরিচিত আগন্তুক দেখে দোতলার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়ায় কয়েকজন শিশু ও কিশোর। একজনের কান্নাজড়িত আকুতি-‘স্যার, একটু আপনের মোবাইলটা দেন না, স্যার। মায়ের সাথে এক মিনিট কথা কইতাম। দেন না স্যার।’ পাশের আরেক শিশু খালি গায়ে সিঁড়ির কাছে দৌড়ে আসে। বলে-‘স্যার, ও স্যার। খিদা লাগছে অনেক।’
আশ্রয় কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইদুর রহমানের অফিস নিচতলায়। তিনি ব্যাগ গুছিয়ে অফিস ত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বেলা তখন সাড়ে ৪টা হবে। এ সময় প্রতিবেদকের মুখে সাংবাদিক শুনে তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। কেন্দ্রের দুরবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করতেই ব্যস্ততা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এভাবে চাইলেই তো আপনার সঙ্গে আমরা কথা বলব না। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে।’
ঘুসের অপর নাম বকশিশ : সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা টু-পাইস (বেতন বহির্ভূত অবৈধ আয়) কামাইয়ে সিদ্ধহস্ত। তবে তারা এটাকে ঘুস বলতে নারাজ। তাদের ভাষায় বকশিশ। এটা নাকি জায়েজ। সবাই নেয়। কিন্তু কেউ ঘুস বলে হৈচৈ করতে চাইলে তাকে সেবা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হবে। এমন চিত্র নিত্যদিনের। সরেজমিন সেবাদানের এমন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলে যে কারো কাছে এমনটিই মনে হবে।
সেবা সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নিবন্ধন পেতে বকশিশ বাণিজ্য অনেকটা ওপেন সিক্রেট। এমনকি বিনা মূল্যের ফরম বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। ২০ ডিসেম্বর আজিমপুরে সমাজসেবার ঢাকা জেলা কার্যালয়ে গিয়ে এর প্রমাণও মেলে। পরিচয় গোপন করে যুগান্তর প্রতিবেদক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ফরম চাইলে আলমারি খোলেন ডেসপাচ শাখার কর্মচারী আশরাফুজ্জামান খান। চার পাতার ফরমের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ নিজ উদ্যোগে ঝটপট বুঝিয়ে দিতে শুরু করেন তিনি। এক পর্যায়ে জোর গলায় বলে ওঠেন- ‘কই ট্যাকা দেন। ফরমের দাম ২শ’ টাকা।’ বিনা মূল্যের ফরমে টাকা চাচ্ছেন কেন-এমন প্রশ্নে আশরাফ তার কণ্ঠে ক্ষোভ ছড়ালেও কিছুটা সতর্ক হন। কয়েক সেকেন্ড দম নিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে বলেন, ভাই ‘ট্যাকা চাইসি, দিলে দিবেন- না থাকলে বলবেন নাই।’ প্রমাণ রাখতে ঘুনের ২শ’ টাকা দেওয়া হয় তার বিকাশ নম্বরে। অবশ্য গোপন ক্যামেরায় পুরো ঘটনার অডিওসহ ভিডিও চিত্র যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত আছে।
আজিমপুরে অবস্থিত সমাজসেবার দিবাযত্ন কেন্দ্রটি চলছে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ২০ ডিসেম্বর দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সি অন্তত ৩০ জন শিশুকে রাখা হয়েছে একটি বড় হলরুমে। সবার দৃষ্টি টিভির পর্দায়। ইউটিউবে দেখানো হচ্ছে ‘মটু পাতলু’ কার্টুন। ওদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই কার্টুনই নাকি তাদের বেশির ভাগ সময় দেখতে হয়। এছাড়া বিনোদনের অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। কেন্দ্রের উপ-তত্ত্বাবধায়ক শিরিন সুলতানার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘এখনই আরবি টিচার আসবে। তখন টিভিও বন্ধ হয়ে যাবে।’
ভিন্ন নামে কারাগার : সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে সরেজমিনে গিয়ে যা দেখা গেল তাতে শুধু হতবাক বললে কম বলা হবে। খাতা-কলমে প্রতিষ্ঠানটিকে শিশুদের জন্য সংশোধনাগার বলা হলেও বাস্তবে এটা একটা ‘কারাগার’। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও ভেতরের আবহ সেটিই বলে দিচ্ছে। দেখা যায়, মুক্তি’র জন্য অপেক্ষমাণ শিশুদের একটি কক্ষে জড়ো করা হচ্ছে। সেখানে শৃঙ্খলা রক্ষায় তটস্থ জহিরুল নামের এক ট্রেড ইন্সপেক্টর। অপেক্ষমাণ শিশুরা একটু এলোমেলো হলেই সজোরে ধাক্কা দিয়ে সোজা করে দিচ্ছেন তিনি। দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের আচরনে সংশোধন করার কোনো ধৈর্য বা আলামতের বালাই নেই।
১৫ ডিসেম্বর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া শুভ নামের এক কিশোরের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। দু’মাসেরও বেশি সময় আটক ছিল সে। তার মুখে উন্নয়ন কেন্দ্রের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা এক কথায় খুবই ভয়াবহ। প্রতিবেদককে সে জানায়, ‘একটি ঘরের মেঝেতে তাদের ২০ জন কিশোর গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে। এতে করে তাদের রাতের ঘুম তো হারাম হয়েছে, উপরন্তু সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা ছিল টয়লেটে যাওয়া। কেননা, ২০ জনের জন্য নির্ধারিত একটি মাত্র টয়লেট। ফলে ভোর রাত থেকেই এক রকম লাইন দিতে হয়। আবার পান থেকে চুন খসলেই নেমে আসে শাস্তির খক্ষ। সর্বনিু শাস্তির নাম ‘নীল ডাউন’। এছাড়া ‘বড় ভাই’ নামের পুরোনো বন্দিদের উৎপাত আছে সব সময়। যারা এখানে এক ধরনের মাস্তানি করে চলে।’
হাসপাতালে জটিল সমাজসেবা : ক্যানসার এবং হৃদরোগের মতো জটিল রোগীদের প্যাকেজ সহায়তা কর্মসূচির কথা অনেকেরই জানা নেই। এ ক্ষেত্রে রোগীপ্রতি ৫০ হাজার টাকার প্যাকেজ নির্ধারিত। কিন্তু এ টাকা পাওয়া অনেকটাই সোনার হাঁসের মতো দুর্লভ। মন্ত্রী, এমপি বা প্রভাবশালীদের সুপারিশ ছাড়া অনুদানের নাগাল পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। এছাড়া অনুদানের টাকা ছাড়ে দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজাল তো আছেই। ফলে অনেক রোগী শেষ পর্যন্ত উপকার ভোগের আগেই হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য হন। আবার কেউ কেউ সাহায্যের আশায় অপেক্ষা করতে করতে চিরবিদায় নেন।
এছাড়া হাসপাতালে সমাজসেবা কার্যক্রম থেকে টাকা পাওয়া অনেকটা গিরিপথ পাড়ি দেওয়ার মতো দুর্গম। তবে খাতা-কলমে ত্রুটি নেই। অর্থ বণ্টনের হিসাব একেবারে পাকা। গত বছর প্রায় ৬ লাখ দুস্থ রোগীকে বিনামূল্যে ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম বণ্টনের দাবি সমাজসেবা অধিদপ্তরের।
ভালো থাকুক আদম-হাওয়ার সন্তানরা : তেজগাঁওয়ে অবস্থিত বালিকা আশ্রয় কেন্দ্রে করুণ এক জীবন্ত চিত্রনাট্য মঞ্চস্থ হচ্ছে সবার অলক্ষ্যে। পরিচয়হীন শিশুদের জীবন যেখানে বড়ই শ্বাসরুদ্ধকর। অবশ্য তাদের এই সংগ্রামী জীবনে সাফল্যের গল্পও কম নয়। কিন্তু বিড়ম্বনার যেন শেষ নেই। স্কুলে ভর্তির জন্য দরকার হয় ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদ। পিতা-মাতাহীন শিশুদের সে পরিচয় তো নেই। যদিও বাস্তবে গর্ভধারিণী মা এবং জন্মদাতা বাবাও নিশ্চয় আছেন। এই সমাজের কেউ না কেউ তাদের পিতা-মাতা। কিন্তু তারা শুধু জন্মই দিয়েছেন। পরিচয় দিতে চাননি। জন্মের পর সন্তানকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে মৃত্যুর মুখে। হয়তো কারও কারও ঠিকানা হয়েছিল হাসপাতাল কিংবা ডাস্টবিন। তাদের কেউ কেউ হয়তো এখানেই বড় হয়ে উঠছে। তাই পিতা-মাতাহীন শিশুদের বাবার নাম লেখা হচ্ছে মৃত আদম এবং মায়ের ঘরে মৃত হাওয়া।
Leave a Reply