চলতি বছর বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে (ইউএনএইচআরসি) প্রতিবেদন জমা দিয়েছে এর গুমসংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ ডব্লিউজিইআইডি (ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস)। প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ পরিস্থিতিও। ইউএনএইচআরসির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং তাদের ও সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ভিত্তিতে ডব্লিউজিইআইডি এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করতে গুমকে অব্যাহতভাবে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। গুমের এসব অভিযোগের বিষয়ে তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে। গুমের শিকার হওয়া থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির সুরক্ষাসংক্রান্ত ঘোষণার (ডিক্লারেশন অন দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স) লঙ্ঘন ও এ ঘোষণা বাস্তবায়নে বাংলাদেশে বাধা দেওয়ার অভিযোগ বিষয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্যও পেয়েছে ডব্লিউজিইআইডি। এসব অভিযোগের বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে যেমন সাড়া পাওয়ার অভাব ছিল, তেমনি বাংলাদেশে সফরের অনুরোধে
সাড়া না পাওয়ার বিষয়টিও রয়েছে। ২০১৩ সালের ১২ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত জবাব দেওয়া হয়নি, যা আরও বেশি অস্বস্তির। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০ জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুম করেছে। যদিও তাদের বেশিরভাগকে হয় মুক্তি দেওয়া হয়েছে কিংবা শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতে হাজির করা হয়েছে। তবে বেশ কয়েকজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। সূত্রগুলো ৮৬টি নথিভুক্ত ঘটনার কথা জানিয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ভাগ্য ও অবস্থান সম্পর্কে অজানা রয়ে গেছে। সূত্রগুলো এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ পুলিশের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন র্যাব মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়িত; যা ২০১৮ সালের মে মাসে শুরু হয়। নিয়মিতভাবে লোকজনকে তুলে নেওয়া, বিচারবহির্ভূতভাবে তাদের হত্যা করা ও লাশ গুমের বেশিরভাগ ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি সবার জানা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিরোধীদের ওপর উল্লিখিত দমনমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গুমের জন্য কীভাবে নজরদারি (শারীরিক নজরদারি, টেলিফোনে আড়ি পাতা, আন্তর্জাতিক মোবাইল গ্রাহক পরিচয়-শনাক্তকরণ, অবস্থানভিত্তিক সামাজিক নেটওয়ার্ক মনিটরিং সিস্টেম সফটওয়্যার ও ওয়াইফাই ইন্টারসেপ্টরের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যম ট্র্যাকিং) চালানো হয়। নজরদারির কৌশলগুলো মহামারীর প্রেক্ষাপটে বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের নিশানা করা হচ্ছে, যারা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের সাড়ার বিষয়ে সমালোচনামুখর বলে মনে হয়।
সূত্রগুলো ডব্লিউজিইআইডিকে জানিয়েছে, ঘটনার তদন্ত যাতে না হয়, সে জন্য গুম হওয়া ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। গুম হওয়া প্রিয়জনকে মুক্তি বা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। এমনও অভিযোগ আছে, পুলিশ কর্মকর্তারা গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত করতে অস্বীকার করেন বা শুধু তখনই গ্রহণ করেন, যখন সেখান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জড়িত থাকার যে কোনো ধরনের অভিযোগ বাদ দেওয়া হয়। যখন অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়, তখন দৃশ্যত কোনো তদন্ত হয় না ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। যেসব ক্ষেত্রে আদালতের তদন্তের নির্দেশ রয়েছে, সেখানেও এমনটা হয়।
ডব্লিউজিইআইডি দাবি করেছে, কথিত আইনি ব্যবস্থার অস্তিত্ব সম্পর্কেও তারা অবগত হয়েছে, যা অপরাধীদের দায়মুক্তি সহজতর করে। কথিত এ আইনি ব্যবস্থার মধ্যে আছে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা বা তা পুনরুদ্ধারে যে কোনো কাজের জন্য একজন সরকারি কর্মকর্তাকে আইনি পন্থায় নিরাপত্তা দিতে জাতীয় সংসদের সাংবিধানিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ওপর আরোপিত কোনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার নিশ্চয়তা। এ আইনি ব্যবস্থার মধ্যে আরও আছে দায়িত্ব পালনকালে সংঘটিত অপরাধের জন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনার আগে সরকারি অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা। উপরন্তু সূত্রগুলো জানিয়েছে, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অর্ডিন্যান্সের ১৩ ধারা র্যাবের যে কোনো সদস্যের বিচার কার্যত অসম্ভব করে তোলে।
Leave a Reply