হুমায়ুন কবির খান, জাল টাকার একজন বড় কারবারি। এক যুগেরও বেশি সময় আগে তার হাত ধরে এ কারবারে নাম লেখান ছোটভাই কাওসার হামিদ খান। টাকা তৈরি এবং বিপণনের কৌশল রপ্ত করেন বড় ভাইয়ের কাছ থেকেই। এখন নিজেই নাটের গুরু। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে গড়েন নিজের রাজ্য। পরিবর্তন করেছেন পদ্ধতিও, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়েছেন ডিজিটাল। এক বছর আগে কাঠের ফ্রেম ছেড়ে বিশেষ সফটঅয়্যারের সাহায্যে জাল টাকা তৈরি শুরু করেন কাওসার।
তবে শেষ রক্ষা হয়নি, গত মঙ্গলবার কদমতলী এলাকা থেকে দুই সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। এ সময় ৪৫ লাখ জাল টাকা ও আরও অর্ধকোটি জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার অন্য দুজন হলেন- হেলাল উদ্দিন ও বাবু শেখ।
এর বাইরে অন্তত আরও ১৫টি চক্র ঢাকা ও ঢাকার বাইরে জাল টাকা সরবরাহ করছে বলে ডিবির কাছে তথ্য রয়েছে। চক্রের হোতারা বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও ছয় মাসের বেশি জেলে রাখা যায়নি। জামিনে বেরিয়ে তারা একই কাজে লিপ্ত। এ চক্রের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও জড়িত রয়েছেন বলেও তথ্য রয়েছে ডিবির কাছে।
ডিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, আধুনিক সফটঅয়্যার ব্যবহার করে জাল টাকা তৈরি করলে জল ছাপ, নিরাপত্তা সুতাসহ সবকিছু নিখুঁত হয়। এ কারণে সেটি দেখতে আসল টাকার মতোই মনে হয়। সাধারণ লোক তো দূরের কথা, অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও এগুলোকে আসল টাকা ভেবে প্রতারিত হচ্ছেন।
সম্প্রতি গ্রেপ্তার চক্রের হোতা কাওসারের বিরুদ্ধে জাল টাকা তৈরি ও বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে বিভিন্ন থানায় আটটি মামলা রয়েছে। এর আগে তিনি একাধিকবার পুলিশ ও র্যাবের হাতে ধরা পড়েছেন; কিন্তু জামিনে বেরিয়ে তিনি আবারও একই কারবার করেন। কাওসারসহ জাল টাকার কারবারিদের যে ইঞ্জিনিয়ার সফটঅয়্যার বানিয়ে দিয়েছেন, তার ব্যাপারেও তথ্য সংগ্রহ করছে ডিবি।
ডিবির সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সোলায়মান মিয়া বলেন, ‘জাল টাকা তৈরি চক্রের হোতা কাওসারসহ তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। এ চক্রের অন্য সদস্যদেরও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।’
বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়েও চক্রটি সক্রিয় রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন- ‘বিভিন্ন মেলা, মাজার ও হাটবাজার টার্গেট করে জাল টাকা জড়িয়ে দিচ্ছে তারা। এবারের বাণিজ্যমেলায়ও এ চক্রের ১০ সদস্য জাল টাকায় কেনাকাটা করে অনেক দোকানদারকে প্রতারিত করেছে বলেও স্বীকার করেছে কাওসার।’
ডিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, জাল টাকা তৈরিতে সারাদেশে সক্রিয় ১৬টি চক্রের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলোর মূল হোতাদের নামও পাওয়া গেছে। তারা হলেন- ইমন, জামান, জাকির, সেলিম, হামির, সিহাব, হুমায়ন কবির, বিহারি সুমন, আমজাদ, কাওসার, সেলিম বেপারি, সাইফুল ওরফে রিকশা সাইফুল, খশরু ও সাগর।
বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার জাল টাকার কারবারিদের জিজ্ঞাসাবাদেই তাদের বিষয়ে তথ্য মিলে। এসব চক্র আগে উৎসবকে ঘিরে জাল টাকা তৈরি করত। এখন তারা সারাবছরই জাল টাকা তৈরি করে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। চক্রের হোতাদের বিরুদ্ধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় তিন থেকে ১০টি করে মামলাও রয়েছে। প্রায় সবাই কোনো না কোনো সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে তিন থেকে ছয় মাসের বেশি কেউ জেল খাটেননি। জামিনে বেরিয়ে আবার একই অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন তারা।
জাল টাকা তৈরিতে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি সংগ্রহের বিষয়ে ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, যে কাগজ ব্যবহার হয়, সেগুলো নীলক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা। অন্যান্য উপাদানের সোর্সÑ বিশেষ করে কেমিক্যাল পুরান ঢাকা থেকে নেয়। আর জাল টাকা বাজারে ছড়ানো হয় তিন ধাপে। আর প্রতিটি চক্রের রয়েছে ২০ থেকে ২৫ সদস্য। তারা বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কাজ করেন। মূল হোতাদের কাছ থেকে তারা ১ লাখ জাল টাকা ১৫ হাজার টাকায় কেনেন।
Leave a Reply