আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযানে শোবিজ জগতের তারকা মডেল, নায়িকা, ভুঁইফোঁড় রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীসহ কথিত সেলিব্রেটিদের মধ্যে চরম আতঙ্ক শুরু হয়েছে। যারা নিজ পেশা ও খ্যাতির আড়ালে নানা অপকর্মের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে বিত্ত-বৈভব গড়েছেন। নিজেদের পরিচিত মুখটা ব্যবহার করে জড়িয়েছেন অবৈধ মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে।
তাদের ধরতে শুরু হয়েছে র্যাব-পুলিশের অভিযান। এ অভিযানে সর্বশেষ গ্রেপ্তার হন ঢালিউডের আলোচিত নায়িকা পরীমনি। এ তালিকায় আরও রয়েছেন সিনেমা পরিচালক, নায়িকা, মডেল, তারকাসহ সমাজের বিভিন্ন জগতের পরিচিত মুখ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, গ্রেপ্তারের তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। এ তালিকায় শতাধিক নাম রয়েছে বলে সূত্র জানায়। ওই তালিকায় সেলিব্রেটিদের গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের সদস্যও রয়েছেন। এ তালিকায় এখন পর্যন্ত ২৫ জনের নাম এসেছে। যাদের ব্যবহার করে মাদক ও ব্ল্যাকমেইলসহ মিনি অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন তারা। একজনকে গ্রেপ্তারের পর তার জবানবন্দি সূত্র ধরে নাম বেরিয়ে আসছে আরেকজনের।
এ ছাড়া তাদের সেলফোনের কললিস্ট যাচাই করে আরও পরিচিত মুখ ও তথাকথিত সেলিব্রেটিদের নাম জানতে পারছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া সামনে চলে আসছে তাদের পরিচিত মুখের অন্তরালে নানা অপকর্মের অজানা তথ্য। গত ২৯ জুলাই রাতে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর।
কথিত ‘চাকরিজীবী লীগ’ গঠনে সম্পৃক্ততার খবরে তোলপাড়ের পরই আটক হন তিনি? আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য পদও হারান হেলেনা জাহাঙ্গীর? চাকরিজীবী লীগ নিয়ে বিতর্ক শুরুর পরই তাকে সেই দায়িত্ব থেকে সরানো হয়। আর হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে র্যাব হরিণের চামড়া, বিদেশি মদ, ক্যাসিনোসামগ্রী, বিদেশি মুদ্রা এবং বেশ কিছু ছুরি ও চাকু উদ্ধার করে। হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে র্যাব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, মাদক, অর্থপাচার আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। গত সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয় হেলেনা জাহাঙ্গীরের দুই সহযোগী হাজেরা খাতুন ও সানাউল্লাহ নুরীকে।
গত রবিবার রাতে গুলশান থানার বারিধারা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা। তার বাসায় অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, ইয়াবা ও সিসা জব্দ করে। পরে তাকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে মডেল মৌয়ের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকেও এসব মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। পরে মৌকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা হয়। তাদের জবানবন্দির সূত্র ধরেই র্যাব ৩ আগস্ট রাতে গ্রেপ্তার করে পিয়াসার সহযোগী মিশু হাসানসহ দুই জনকে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) হারুন-অর-রশীদ আমাদের সময়কে বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া মডেল পিয়াসা ও মৌ রাতে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পার্টির নামে বাসায় ডেকে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করতেন। এমনকি ভিডিও করে রাখতেন। পরে সেসব ভিডিও ও ছবি ভিকটিমদের পরিবারকে পাঠানোর হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন এবং মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতেন। তিনি সংখ্যা উল্লেখ না করে জিজ্ঞাসাবাদে আরও অনেক পরিচিত মুখের নাম বেরিয়ে আসছে বলে জানান। যারা পিয়াসাচক্রের সদস্য।
গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, পিয়াসা ও মৌ চক্রের হাতে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন। আবার সমাজের অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গে তাদের সখ্যতা ছিল। এ দুই মডেল শুধু অসামাজিক ব্যবসা নয়, জড়িত ছিলেন মাদক ব্যবসার সঙ্গেও। তাদের সেলফোনের গত এক মাসের কল ডিটেইল রেকর্ড (কললিস্ট) ঘেঁটে অনেক পিলে চমকানো তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তাদের প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলচক্রে আরও যেসব নারী, গ্ল্যামার জগতের তারকা যুক্ত ছিলেন তাদের নামধাম জানতে পেরেছে। এ তালিকায় শতাধিক নারী, পুরুষ, তারকা ও মডেল রয়েছেন বলে পুলিশ সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সূত্র আরও বলেছে, পিয়াসা ও মৌ চক্রের টার্গেটই থাকে সমাজের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ বিত্তবান ও তাদের সন্তান। নানা প্রলোভনে তাদের বাসায় ডেকে মদ ও ইয়াবার জালে ফেলে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই মূল লক্ষ্য। একদিকে চলত ডিজে পার্টি আরেকদিকে ব্ল্যাকমেইল। বছরের পর বছর ধরে তারা এ কাজ করে আসছিলেন।
পুলিশ বলছে মডেল পিয়াসা ও মৌ একের পর এক বিয়ে করেও হাতিয়ে নিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। মডেল মৌয়ের ১১টি বিয়ের খবর ইতোমধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। মডেল পিয়াসাও একাধিক বিয়ে করেছেন। একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর ছেলেকেও ব্ল্যাকমেইলের জালে ফেলে কয়েক বছর আগে বিয়ে করেন। এর পর তার কাছ থেকে ৫ কোটি টাকা বাগিয়ে নেন। এ ছাড়া বেনামে ফ্ল্যাটেরও মালিক হয়েছেন পিয়াসা।
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, ঢাকার গ্লামার জগতের উঠতি মডেল, অভিনেত্রী ও নায়িকা শোবিজে পা দিয়ে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক হয়ে যাচ্ছেন। তাদের এ অবৈধ সম্পদের পেছনে রয়েছে মাদক ও অনৈতিক উপায়। শোবিজ জগতের অনেকেই মাদক সেবন ও ব্যবসার পাশাপাশি নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত। তারা টাকার জন্য অনেক বিত্তবান পরিবারের সন্তানদের বিপথগামী করেছেন। গুলশান, বনানী, বারিধারার অনেক পরিবারই এখন তাদের কারণে ভুক্তভোগী।
গৃহকর্মীকে মারধরের ঘটনায় গত ৩১ জুলাই রাতে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন এককালের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা একা। এর পর বেরিয়ে আসে, এ নায়িকার জীবনের আরেক গল্প। নিয়মিত মাদক সেবন করায় তার স্বাভাবিক জীবন প্রায় তছনছ হওয়ার পথে। এ নায়িকার বাসা থেকেও ইয়াবা, গাঁজা এবং মদ পাওয়া যায়। পুলিশের কাছে তিনি নিয়মিত ইয়াবা সেবনের কথা স্বীকারও করেন। গ্রেপ্তারের পর পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই তার চেহারার হাল দেখে অনেকেই বলেন, তার চেহারার যে হাল হয়েছে তা দেখে বলার উপায় নেই তিনি এক সময় জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন।
চিত্রনায়িকা পরীমনির বিরুদ্ধেও নানা অনৈতিক কাজের অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। বোটক্ল্যাবের ঘটনায় বেরিয়ে আসে চিত্রনায়িকা পরীমনির অনেক অজানা গল্প। তার বিরুদ্ধেও ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। গতকাল এ নায়িকাকে আটকের পর তার বাসা থেকে মাদক উদ্ধারের কথা জানিয়েছে র্যাব।
এদিকে গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের সভাপতি মনির খান ওরফে দর্জি মনির। ভুঁইফোঁড় এ সংগঠনের সভাপতি মনির কমিটি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েও বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন দর্জি মনির।
ওদিকে একের পর এক মডেল ও সেলিব্রিটিদের বাসা থেকে মদ উদ্ধারের ঘটনায় রাজধানীর অভিজাত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। তারা বাসায় থাকা মদ এখন অন্যত্র সরিয়ে ফেলছেন। অথবা ফেলেও দিচ্ছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
Leave a Reply