অব্যবস্থাপনা ও অবহেলায় কুষ্টিয়া করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল (কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল) মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, করোনা পজিটিভ শত শত রোগী হাসপাতালের বেডে মরণ যন্ত্রণায় কাতরালেও দেখা মিলছে না কর্তব্যরত চিকিৎসকের। গত দেড় মাসে চিকিৎসার অভাবে এ হাসপাতালে মারা গেছে ৩২১ করোনা রোগী। ফলে স্বজনদের মধ্যে এখন মৃত্যু আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই ক্ষণে ক্ষণে হাসপাতালজুড়ে স্বজনদের কান্নার রোল উঠে। প্রতিদিন লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে স্বজনদের। তাদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে হাসপাতালের পরিবেশ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়া করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ চিকিৎসাসামগ্রীর অভাব না থাকলেও ডাক্তার ও নার্সদের অবহেলার কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে করোনা রোগীরা। স্বজনদের অভিযোগ, বিনামূল্যে দেওয়ার কথা থাকলেও ঘুষ ছাড়া মিলছে না অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ওষুধপত্র। হাসপাতালটিতে অক্সিজেন না পেয়ে বেশ কয়েকজন রোগী মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় কুষ্টিয়া সদর আসনের এমপি মাহবুব-উল-আলম হানিফের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না রোগীরা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট না থাকলেও মান নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। নিয়ম অনুযায়ী অক্সিজেন সিলিন্ডারের প্রেসার থাকার কথা ২ হাজারের ওপরে। কিন্তু হাসপাতালে সরবরাহকৃত রিফিল করা অক্সিজেন সিলিন্ডারের প্রেসার ১২শ থেকে ১৪শর বেশি উঠছে না। এমনকি পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা অক্সিজেন থাকার কথা থাকলেও এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে অক্সিজেন শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রোগীর স্বজনদের। এ অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন করোনা রোগীদের সেবা দেওয়ার দায়িত্বে থাকা ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা।
কুষ্টিয়া করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের অক্সিজেন ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে নিয়োজিত ডা. আরিফুজ্জামানকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে কথা বলেন। তত্ত্বাবধায়ক ডা. এমএ মোমেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, প্রতিটি সিলিন্ডার চেক করে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল আমাদের নেই। হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মনির অক্সিজেনকে আমরা মৌখিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছি। যাতে অক্সিজেনের প্রেসার সঠিকভাবে পাওয়া যায় সেটি নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কুষ্টিয়া করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছাত্রলীগের এক কর্মী বলেন, হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সদের কাছে রোগীরা জিম্মি। টাকা ছাড়া কেউ চিকিৎসা পাচ্ছে না এখানে। তিনি আরও বলেন, গত ১৭ জুলাই কুষ্টিয়া সদর উপজেলার স্বর্গপুরের আনোয়ারা খাতুন (৩৫) ও ১৮ জুলাই মেরিনা খাতুন (৩০) হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় অক্সিজেনের অভাবে মারা যান। চোখের সামনে করোনা রোগীরা ছটফট করে মারা যাচ্ছে দেখে কষ্ট পেলেও আমরা কিছু করতে পারছি না।
এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক ডা. এমএ মোমেন জানান, বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা যাক এটি আমাদের কাম্য নয়। বিষয়টি জানার পর কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত ডা. সালেক মাসুদ ও করেনা ওয়ার্ডের দায়িত্বরত চিকিৎসককে সমন্বয় করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কোনো চিকিৎসক কিংবা নার্সের গাফিলতি প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও জানান, এ হাসপাতালে ১৪৩টি বেডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সংযোগ রয়েছে। ২৪টি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানোলা ও ৬৫০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা নিয়মিত রোগীদের খোঁজ নেন না। চেম্বারে বসে ফাইল দেখে ব্যবস্থাপত্র দেন তারা।
মৃত্যুর মিছিলে আরও ১৮ জন
জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় চিকিৎসাধীন আরও ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জন করোনায় ও চারজন উপসর্গ নিয়ে মারা যান। এ ছাড়া ৫৩৩টি নমুনা পরীক্ষায় ১৮১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। রবিবার সকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসাধীন থেকে তাদের মৃত্যু হয়। করোনা শনাক্তদের মধ্যে কুমারখালীর আট, দৌলতপুরের ৩১, ভেড়ামারার চার, মিরপুরের ২৯ ও খোকসার ১৩ জন। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার গতদিনের চেয়ে বেড়ে ৩৩.৯৫ শতাংশ হয়েছে। এই সময়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২০৮ জন।
ডা. এমএ মোমেন বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার কারণে মানুষ আগের চেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। করোনার নতুন স্ট্রেইন ছড়িয়ে পড়ায় একজনের দ্বারা অনেক লোক আক্রান্ত হতে পারেন। এ জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে।
Leave a Reply