কুড়িগ্রাম জেলায় পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১৯ মাসে দেশের বন্যাপ্রবণ এ জেলায় অন্তত ৬৩ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। নিহতদের ৪৫ জনের বয়স নয় বছরের কম। পারিবারিক সদস্যদের অগোচরে এসব শিশুরা পানির সংস্পর্শে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। নিহতদের মধ্যে ২৬ জন নারী ও কন্যাশিশু এবং ৩৭ জন পুরুষ ও ছেলেশিশু। তাদের মধ্যে অন্তত ১৮ জন বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে। অন্যদিকে গত ১৯ মাসে পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এ বিভাগের সবক’টি জেলায় অন্তত ২৭১ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ২২৮টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। বিশ্ব পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমষ্টির গবেষণায় এমন তথ্য এসেছে। এদিকে চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথমবারের মতো পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধবিষয়ক একটি ঐতিহাসিক রেজুলেশন গৃহীত হয়। ফলে জাতিসংঘ ২৫ জুলাইকে ‘বিশ^ পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। আজ রবিবার (২৫ জুলাই)
বিশ^ব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও এ উপলক্ষে কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, কুড়িগ্রাম ছাড়া এ সময় আরও ১৭টি জেলায় অন্তত ৩০ জন বা তার বেশি সংখ্যক মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে নেত্রকোনায় ৫৪ জন, কিশোরগঞ্জে ৪৩, চট্টগ্রামে ৪২, পটুয়াখালীতে ৩৯ এবং দিনাজপুর ও সিরাগঞ্জে ৩৭ জন করে মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। অন্যদিকে শরীয়তপুর জেলায় পানিতে ডুবে সবচেয়ে কম মানুষের মৃত্যু ঘটে। গত ১৯ মাসে এ জেলায় দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কম মৃত্যুর দিক থেকে নড়াইল, মাগুরা, বান্দরবান, রাজবাড়ী ও খুলনা জেলাও রয়েছে। এসব জেলায় উল্লিখিত ১৯ মাসে মৃত্যু ছিল ২ থেকে ৫ জনের মধ্যে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে এ রকম তথ্য তুলে ধরেছে সংস্থাটি। গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান সমষ্টি ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রবণতা বিশ্লেষণ করে আসছে।
সমষ্টির বিশ্লেষণ বলছে, গত ১৯ মাসে (গত ২৩ জুলাই পর্যন্ত) ৯৬৭টি ঘটনায় ১ হাজার ৫১২ জন পানিতে ডুবে অথবা নৌযান দুর্ঘটনায় মারা যায়। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৩২ জন পানিতে ডুবে এবং ১৮০ জন নৌযান দুর্ঘটনায় ডুবে বা আহত হয়ে মারা যায়। উভয় ঘটনায় মৃতদের ১ হাজার ৫৬ জনের (৭০ শতাংশ) বয়স ১০ বছরের কম। পানিতে ডুবে মৃতদের মধ্যে নারী ও কন্যাশিশু ৫৪৯ জন (৩৬%), পুরুষ ও ছেলেশিশু ৯৫৭ জন (৬ জন)। গণমাধ্যম সংবাদ থেকে ৬ জনের লৈঙ্গিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাগুলোর জাতীয়ভাবে কার্যকর তথ্যায়ন ব্যবস্থা না থাকায় বেশিরভাগ ঘটনাই গণমাধ্যমে উঠে আসে না। ফলে এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে জাতীয়ভাবে সর্বশেষ জরিপটি হয়েছে ২০১৬ সালে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ পরিচালিত ওই জরিপে তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী প্রতিবছর সব বয়সী প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি অর্থাৎ আনুমানিক ১৪ হাজার ৫০০ জনই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু।
অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের শিশুরা পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন, অর্থাৎ বছরে প্রায় ১০ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর ৪৩ শতাংশের কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া।
সমষ্টির গবেষণায় দেখা গেছে, গত ১৯ মাসে নৌযান দুর্ঘটনা বাদে পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম বিভাগে, ২৭১ জন (২০%)। এ ছাড়া ঢাকায় ২২৮ জন, রংপুরে ২০১, রাজশাহীতে ১৮৫, ময়মনসিংহে ১৪১, বরিশালে ১২৭, খুলনা বিভাগে ১০৮ জন মারা যায়। এ সময়ে সবচেয়ে কম মৃত্যু ছিল সিলেট বিভাগে, ৭১ জন (৫%)।
পানিতে ডুবে মৃতদের ৯১ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের কম। চার বছর বা কম বয়সীদের মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু সবচয়ে বেশি, ৫৬২ জন (৪২%)। ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৪৬২ জন (৩৫%), ১০-১৪ বছরের ১৫২ জন এবং ১৫-১৮ বছরের ৩৮ জন। ১১৮ জনের বয়স ছিল ১৮ বছরের বেশি।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে পানিতে ডোবার ৭৯ শতাংশ ঘটনা ঘটে দিনের বেলায়। দিনের বেলায় শিশুরা পানির সংস্পর্শে বেশি যায়। দিনের প্রথম ভাগে অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ৫৩৭ জন (৪০%) এবং দুপুর থেকে সন্ধ্যার আগে ৫১৭ (৩৯%) জন মারা যায়। তবে রাতেও পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সন্ধ্যা বা রাতে ২৬৫ (২০%) জনের মৃত্যু হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে ১২ জনের পানিতে ডোবার সময় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বর্ষাকাল ও এর আগে-পরের মাসগুলোতে (জুন-অক্টোবর) পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০২০ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৩২ জন মারা যায় আগস্ট মাসে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল জুলাই মাসে ১২৪ জন। এ বছরের জুলাই মাসে (২৩ জুলাই পর্যন্ত) ১২৮ জনের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তবে মে ও জুন মাসেও শতাধিক করে মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ দুই মাসে যথাক্রমে ১১৪ ও ১৪২ জন পানিতে ডুবে মারা যায়।
পরিবারের সদস্যদের যথাযথ নজরদারি না থাকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পানিতে ডোবার ঘটনা ঘটে। পানিতে ডুবে ১ হাজার ৩৩২টি মৃত্যুর প্রায় ৯৭ শতাংশ (১,৩০৫) ঘটে পরিবারের অন্য সদস্যদের অগোচরে। অধিকাংশ শিশু বড়দের অগোচরে বাড়িসংলগ্ন পুকুর বা অন্য জলাশয়ে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
একই পরিবারের একাধিক সদস্য পানিতে ডুবে মারা গেছে। গত ১৯ মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়Ñ ১০৯টি পরিবারের ২৪৫ জন সদস্য পানিতে ডুবে মারা যায়। যাদের মধ্যে শিশুর সঙ্গে ভাই অথবা বোনসহ ১২১ জন, বাবা-মাসহ ১৬ জন, দাদা-দাদি বা নানা-নানিসহ ৮ জন, চাচাতো বা খালাতো ভাই বা বোনসহ ৮৫ জন, চাচা-খালাসহ ১৫ জন মারা যায়। উৎসব বা অন্য কোনো সময়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে একই পরিবারের বেশিরভাগ শিশু মারা যায়।
পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক দিবস আজ
এ বছর ২৮ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথমবারের মতো পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধবিষয়ক একটি ঐতিহাসিক রেজুলেশন গৃহীত হয়। ফলে জাতিসংঘ ২৫ জুলাইকে ‘বিশ^ পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। রেজুলেশনটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথম উত্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা।
Leave a Reply