স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে জোবেদা খাতুন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (জেকেজি হেলথকেয়ার) ও রিজেন্ট হাসপাতালের চুক্তি ছিল, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করবে এ দুটি প্রতিষ্ঠান। এর পর এসব নমুনা আইইডিসিআরের মাধ্যমে পরীক্ষা করে যথার্থ রিপোর্ট দেবে। কিন্তু করোনা পরীক্ষা না করেই হাজার হাজার ভুয়া রিপোর্ট প্রদান এবং নমুনা সংগ্রহের বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা আদায় ও আত্মসাৎ করে হাসপাতাল দুটি। করোনার এ ক্রান্তিকালে এভাবে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এবং এত বড় প্রতিষ্ঠানের যাচ্ছেতাই জাল সার্টিফিকেট প্রদানের মতো ন্যক্কারজনক কাণ্ডে দেশবাসী বিস্মিত হয়ে পড়ে। এর পর একে একে ধরা পড়ে ডা. সাবরিনা, সাহেদ, আরিফুলসহ প্রতারকচক্রের অনেকেই।
এসব কাণ্ডে দায়ের করা দুটি প্রতারণার মামলার বিচারপ্রক্রিয়া গত প্রায় এক বছরে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে আদালতে বিচারকাজ বন্ধ। তাই স্থবির হয়ে পড়েছে প্রতারক সাহেদ-সাবরিনার বিচারও। যদিও সাহেদকে অন্য (অস্ত্র) একটি মামলায় ইতোমধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
জানতে চাইলে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রতারক সাহেদের মামলার ব্যাপারে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মো. আবদুল্লাহ আবু আমাদের সময়কে বলেন, সাহেদের মামলাটির বিচার এখন সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমানে করোনা মহামারীর সংক্রমণ এড়াতে আদালতে বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। করোনার সংক্রমণ কমে গেলে আদালত খোলার পর দ্রুত এ মামলাটির বিচার শেষ করা হবে।
প্রতারক ডা. সাবরিনার মামলার বিচারের ব্যাপারে জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আজাদ রহমান বলেন, এ মামলায় ৪০ সাক্ষীর মধ্যে ১৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। করোনার কারণে বর্তমানে বিচার বন্ধ রয়েছে। তবে করোনা সংক্রমণ কমে গেলে আদালত খোলার পর দ্রুত এ মামলাটির বিচার শেষ হয়ে যাবে।
জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রতারণা : করোনা পরীক্ষার সনদ জালিয়াতির অভিযোগে গত বছরের ২৩ জুন জেকেজি হেলথকেয়ার প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরীসহ প্রতিষ্ঠানটির ছয় কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। ডা. সাবরিনার দ্বিতীয় স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী। তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে করোনা সনদ জালিয়াতিতে ডা. সাবরিনার নাম আসে। গত বছরের ১২ জুলাই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ও কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইন ওরফে ডা. সাবরিনা চৌধুরীকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কারও করা হয়।
এদিকে গ্রেপ্তারের পর জেকেজি হেলথকেয়ারের কর্মচারী হুমায়ুন কবির ও তার স্ত্রী ওই হাসপাতালের নার্স তানজিনা পাটোয়ারী গত বছরের ২৪ জুন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে হুমায়ুন কবীর জেকেজি হেলথকেয়ারে চাকরি করার সময় কীভাবে করোনার নমুনা সংগ্রহ এবং ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করেছেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরেন। হুমায়ুন কবির জবানবন্দিতে বলেন, করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করে ড্রেনে ফেলে দিতেন। এ ছাড়া শফিকুল ইসলাম নামের একজন কর্মচারীও আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শর্ত ছিল বিনামূল্যে করোনার নমুনা সংগ্রহ করার। কিন্তু জেকেজি হেলথকেয়ার ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার ৬০০ টাকার বিনিময়ে নমুনা সংগ্রহ করছিল এবং এর পরও সেসব নমুনা পরীক্ষা না করে ভুয়া প্রতিবেদন দিচ্ছিল। রাজধানীর কল্যাণপুরের কামাল হোসেন নামের এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ প্রথমে সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, অধিদপ্তরের সঙ্গে প্রতারণা করেছে জেকেজি।
পুলিশ জানায়, জেকেজি হেলথকেয়ার থেকে ২৭ হাজার রোগীকে করোনা টেস্টের রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনা আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানটির ল্যাপটপে তৈরি করা হয়। জব্দ করা ল্যাপটপে এর প্রমাণ মিলেছে। জেকেজির মাঠকর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনা উপসর্গবাহী মানুষের নমুনা সংগ্রহ করত। প্রতি রিপোর্টে পরীক্ষার কথা বলে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা নিত। আর বিদেশিদের কাছ থেকে নিত ৮০ থেকে ১০০ মার্কিন ডলার। সেই হিসাবে, করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্টে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে পুলিশের ধারণা।
গত বছরের ৫ আগস্ট করোনার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে ডা. সাবরিনা, আরিফুল হক চৌধুরীসহ আটজনের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিএমপি)। অভিযোগপত্রে বলা হয়, করোনা জালিয়াতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন জেকেজির সাবরিনা ও তার স্বামী জেকেজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল হক চৌধুরী। এ দুজন ছাড়াও মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত অন্য ছয় আসামি হলো- জেকেজির সমন্বয়ক সাঈদ চৌধুরী, জেকেজির সাবেক কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির, তার স্ত্রী তানজিনা পাটোয়ারী, বিপ্লব দাস, শফিকুল ইসলাম ও জেবুন্নেসা। মামলা থেকে মামুনুর রশীদ নামের এক আসামিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। গত বছরের ২০ আগস্ট করোনার নমুনা জালিয়াতির মামলায় সাবরিনা, আরিফুল হকসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এর পর শুরু হয় বিচার।
রিজেন্টের সাহেদের প্রতারণা : গত বছরের ৬ জুলাই রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে ভুয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে। রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরদিন ৭ জুলাই রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদসহ ১৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়। পরে মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়। অভিযানের সময় ৮ জনকে আটক করা হলেও চেয়ারম্যানসহ ৯ জন পলাতক ছিলেন।
পরে ১৪ জুলাই রিজেন্টের এমডি মাসুদ পারভেজকে গাজীপুর থেকে এবং ১৫ জুলাই ভোরে ছদ্মবেশে ভারতে পালানোর সময় সাতক্ষীরার দেবহাটায় গ্রেপ্তার হন সাহেদ। পরে তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়। গত বছরের ১৬ জুলাই সাহেদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সাহেদকে নিয়ে গত বছরের ১৮ জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি পিস্তল ও মাদক উদ্ধার করে। পরে অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে একটি মামলা হয়। এ মামলায় গত বছরের ৩০ জুলাই সাহেদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। পরে এ মামলার বিচার শেষে গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর বিচারিক আদালত সাহেদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
এদিকে গত বছরের ২০ জুলাই রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় মেট্রোরেল প্রকল্পের একটি সাব-কন্ট্রাক্টর প্রতিষ্ঠান একসিডের পক্ষে রেজাউল করিম বাদী হয়ে আরও একটি প্রতারণার মামলা করেন। মামলায় সাহেদ, মিজানুরসহ অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়, মেট্রোরেলে কর্মরত ৭৬ কর্মীর করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে রিজেন্ট হাসপাতাল। এ জন্য মাথাপিছু সাড়ে ৩ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। কিন্তু কোনোরকম পরীক্ষা না করেই পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করা হয়।
রিপোর্টে দেখা যায়, তিন কর্মী করোনা পজিটিভ এবং ৭৩ কর্মী নেগেটিভ। পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি জানতে পারে, রিজেন্টের দেওয়া ৭৬ কর্মীর রিপোর্টই ভুয়া। মামলার বাদীর অভিযোগ, এ ভুয়া রিপোর্টের কারণে মেট্রোরেল প্রকল্পের কর্মীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যায়। বহুরূপী প্রতারক সাহেদের বিরুদ্ধে সারাদেশে অর্ধশতাধিক মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানাতেই রয়েছে ১৩টি মামলা।
Leave a Reply