গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে আলোচিত সেই জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেল। নৃশংস ওই হামলার ঘটনায় বিচারিক আদালত থেকে সাত আসামিকে মৃত্যুদ- দেওয়ার পর তা ডেথরেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে এসেছে প্রায় তিন বছর আগে।
বর্তমানে এই ডেথরেফারেন্স মামলার পেপারবুক (মামলার এফআইআর, অধস্তন আদালতের রায়সহ যাবতীয় নথি) প্রস্তুত হয়েছে। এখন আনুষঙ্গিক কিছু কার্যক্রম বাকি রয়েছে। আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষে এই ডেথরেফারেন্সের শুনানির জন্য একটি বেঞ্চ নির্ধারণে মামলার নথি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হবে। এর পর প্রধান বিচারপতি ডেথরেফারেন্স মামলাটি শুনানির জন্য একটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেবেন। বেঞ্চ নির্ধারণের পরই তা শুনানি হবে।
জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিমকোর্টের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, এ জঙ্গি মামলার পেপারবুক প্রস্তুত হয়েছে। তবে পেপারবুক প্রস্তুতের পর আনুষঙ্গিক কিছু কাজ বাকি থাকে। আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হলে ডেথরেফারেন্সটি শুনানির জন্য একটি বেঞ্চ নির্ধারণ করতে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্বজুড়ে উগ্রপন্থার প্রসারের মধ্যে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে একদল তরুণের ওই আত্মঘাতী হামলা বাংলাদেশকে বদলে দেয় অনেকখানি। বিশ্ব দরবারে এদেশকে যেন নতুনভাবে পরিচিত করে তোলার চেষ্টা চালায়। হামলা চালায় গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় লেকের তীরে হলি আর্টিজান বেকারিতে। ওই বেকারির সবুজ লন ছিল বিদেশিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। বিদেশিদের নিয়মিত আনাগোনা এবং শিথিল নিরাপত্তার কারণেই ওই রেস্তোরাঁকে জঙ্গিরা হামলার জন্য বেছে নিয়েছিল বলে তদন্তকারীদের ধারণা।
রোজার ঈদের মাত্র এক সপ্তাহ আগে যে দিন ওই হামলা হয়, সেদিন ছিল শুক্রবার। পিস্তল, সাব মেশিনগান আর ধারালো অস্ত্র হাতে পাঁচ তরুণ রাত পৌনে ৯টার দিকে ওই ক্যাফেতে ঢুকে শুরু করে নৃশংসতা। জবাই ও গুলি করে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে তারা। নিহতদের মধ্যে নয়জন ইতালীয়, সাতজন জাপানি, একজন ভারতীয়, একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান দ্বৈত নাগরিক ও দুজন বাংলাদেশি।
এ হামলা ঠেকাতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের ছোড়া গ্রেনেডের আঘাতে প্রাণ হারান বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন আহমেদ ও সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল ইসলাম। অভিযানের সময় ও পরে হাসপাতালে মারা যায় হলি আর্টিজান বেকারির দুই কর্মচারী। এ হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামে চলে আসে; তখনো অনেকে হলি আর্টিজানের ভেতরে কার্যত জিম্মি হয়ে ছিলেন। রুদ্ধশ্বাস রাত পেরিয়ে ভোরে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা নামে অভিযানে; ‘থান্ডারবোল্ট’ নামের সেই অভিযানে হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ তরুণের সবাই মারা পড়ে। তারা হলেন- মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে মামুন, নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।
হলি আর্টিজানের ভেতর থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় মোট ১৩ জনকে। এর পর দুই বছরে হামলায় জড়িত আরও অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছেন। গুলশান হামলার তদন্তে মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করা হলেও তাদের মধ্যে জীবিত অবস্থায় গ্রেপ্তার আটজনকেই কেবল বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দেন। ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজা করিমও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান। রাষ্ট্রপক্ষে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য শুনে বিচারক ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর রায় দেন।
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান তার রায়ে একজনকে খালাস দিয়ে সাতজনের মৃত্যুদ- দেন। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আবদুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদ- কার্যকর করার আদেশ দিয়ে বিচারক তার রায়ে বলেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে আসামিরা ‘জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ’ ঘটিয়েছে। সাজার ক্ষেত্রে তারা কোনো অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ না হওয়ায় এ মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেওয়া হয়েছে রায়ে।
এ রায়ের পর ঐ বছরই মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয় ডেথরেফারেন্স হিসেবে। আইনজীবীরা জানান, ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালত যখন আসামিদের মৃত্যুদ- দেন তখন ওই দ- কার্যকরের জন্য হাইকোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা মোতাবেক মামলার সব নথি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন। যা ডেথরেফারেন্স নামে পরিচিত। ওই নথি আসার পর হাইকোর্টের ডেথরেফারেন্স শাখা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে।
গত বছর আগস্টে সুপ্রিমকোর্টের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পেপারবুক প্রস্তুত হয়ে বিজি প্রেস থেকে হাইকোর্টে এসেছে। এখন মূলত বেঞ্চ নির্ধারণ হলেই হাইকোর্টে শুনানি শুরু হবে আলোচিত এ জঙ্গি হামলার।
Leave a Reply