কালোটাকা অর্থনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বিশেষ সুবিধা দেয় সরকার। সেই সুবিধায় ব্যাপক সাড়া মিলেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রেকর্ড পরিমাণ কালোটাকা সাদা হয়েছে। প্রথম নয় মাস (জুলাই-মার্চ) পর্যন্ত ১০ হাজার ৩৪ জন ১৪ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা সাদা করেছেন। এর বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। খবর এনবিআর সূত্রের।
আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। যদিও কালোটাকা সাদা করার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের সমালোচনা রয়েছে। তবে অর্থনীতির মূলধারায় কালো টাকা ফিরিয়ে আনতে এ উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ (কালোটাকা) যত দিন মূলধারার বাইরে থাকবে, তত দিন তা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হবে। আমাদের সিস্টেমের কারণে জমি ও ভবন রেজিস্ট্রেশনের সময় অপ্রদর্শিত অর্থ তৈরি হচ্ছে। আমরা আশা করছি, আস্তে আস্তে অপ্রদর্শিত অর্থ আমাদের অর্থনৈতিক সিস্টেম থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে এ বছরের মতো ১০ শতাংশ ট্যাক্সে সাদা
করার সুযোগ থাকবে কিনা, তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকবে।
চলতি বছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছিল, প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের চলতি অর্থবছরে আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যে কোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে কর্তৃপক্ষের কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না। একই সময় ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করলে, ওই বিনিয়োগের ওপর ১০ শতাংশ কর দিলে আয়করসহ কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করবে না।
এ ছাড়া দেশীয় বিনিয়োগ চাঙা করতে এর আগের অর্থবছরে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে একই হারে কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয় সরকার। ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই সুযোগ বলবৎ আছে।
আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকলে বিশেষ সুবিধা প্রত্যাহার করা হতে পারে। এনবআির সূত্র জানিয়েছে, মূলধারার অর্থনীতিতে কালোটাকা আনতে এক বছরের জন্য এ বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এর সময়সীমা আর বাড়ানো হবে না। কারণ দেশে ব্যক্তিশ্রেণির সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ। এ সুযোগ অব্যাহত রাখা হলে করদাতারা নিয়মিত কর না দিয়ে তা লুকিয়ে রেখে পরবর্তীকালে কম হারে কর দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। এ পদ্ধতি চালু রাখলে সৎ ও নিয়মিত করদাতাদের নিরুৎসাহিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ বিশেষ বিধান বাতিল করে আগের সব পদ্ধতি বহাল রাখা হচ্ছে।
এ পদ্ধতি ছাড়াও বর্তমানে আরও ৩ পদ্ধতিতে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ (কালোটাকা সাদা) করা যায়। আয়কর অধ্যাদেশের ১৯ (ই) ধারা অনুযায়ী, নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে যে কোনো খাতেই কালোটাকা বিনিয়োগ করা যায়।
কালোটাকার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে নানাভাবেই কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। মূলত কালোটাকাকে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে এ সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা সাদা করা হয়েছে। তৎকালে এ থেকে সরকার মাত্র ১৯ লাখ টাকা আয়কর পায়। পরে এ সুবিধা বহাল থাকায় প্রতিবছরই কালোটাকা সাদা করার পরিমাণ বাড়তে থাকে।
১৯৭৬-৮০ সাল পর্যন্ত ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা করা হয়, সরকার আয়কর পায় ৮১ লাখ টাকা। ১৯৮১-৯০ পর্যন্ত ৪৫ কোটি টাকা সাদা হয়; সরকার আয়কর পায় ৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ১৯৯১-৯৬ পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা সাদা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৫ কোটি টাকা। ১৯৯৭-২০০০ পর্যন্ত ৯৫০ কোটি টাকা সাদা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৪১ কোটি টাকা। পরের ৭ বছর অর্থাৎ ২০০১-০৭ পর্যন্ত ৮২৭ কোটি টাকা, ২০০৭-০৯ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা, ২০০৯-১৩ পর্যন্ত ১ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা এবং ২০১৩-২০ পর্যন্ত ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা মূলধারার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। এ বছরগুলোতে সরকার রাজস্ব পায় যথাক্রমে ১০২ কোটি, ৯১১ কোটি, ২৩০ কোটি ও ১ হাজার ৭৩ কোটি টাকা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার ফলে একদিকে সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে; অন্যদিকে অসৎ করদাতাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। এটা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এ সুযোগ না দিয়ে বরং কালোটাকার উৎস বন্ধ করা দরকার।
Leave a Reply