গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বিমান ও কামান হামলা অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যেই নিহতের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। সময় যতই গড়াচ্ছে, ইসরাইল হামলার তীব্রতাও বাড়াচ্ছে। গাজা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসও রকেট নিক্ষেপ করে এর জবাব দিচ্ছে।
ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডএফ জানায়, তারা উচ্চপদস্থ হামাস কমান্ডারদের ৯টি বাড়িতে এসব হামলা চালিয়েছে। এছাড়া হামাসের অস্ত্র গুদাম, ৯ মাইল জুড়ে বিস্তৃত ভূগর্ভস্থ টানেলও ছিল তাদের টার্গেট।
ইসরাইলি বাহিনী জানিয়েছে, ইসরাইলের দিকে হামাস ৭০টি রকেট নিক্ষেপ করেছে। এগুলোর ১০টি গাজাতেই ভূপাতিত হয়েছে। আর বাকিগুলো আয়রন ডোম বাধা দিয়েছে। তবে অ্যাশকেলনে একটি রকেট এক সিনাগগে আঘাত হানলে সেটি বিধ্বস্ত হয়। প্রার্থনার কিছু সময় আগে রকেটটি তাতে আঘাত হানে।
সোমবার কতজন নিহত হয়েছে, তা জানা যায়নি, তবে রোববার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ছিল ২০৭। এদের মধ্যে অন্তত ৫৯টি শিশুসহ ১৯৭ জন ছিল ফিলিস্তিনি। ইসরাইলে নিহত হয়েছে একটি শিশুসহ ১০ জন।
ইসরাইল হামলা চালানো শুরু করার পর থেকে অন্তত ১২ শ’ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে।
সূত্র : ডেইলি মেইল
গাজায় ইসরাইলের টার্গেট বনাম হামাসের সাফল্য
গাজায় গত সোমবার থেকে যে ভয়াবহ মাত্রায় বিমান হামলা ইসরাইল করছে তার নজির বিরল।
গাজায় বিবিসির এক সংবাদদাতা বলছেন, বহু ইসরাইলি হামলার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি, কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর হামলা আগে দেখেননি। রুশদি আবুলাউফ টুইট করেছেন, গাজার সর্বত্র বিস্ফোরণ হচ্ছে। কোথায় বোমা পড়লো যোগাযোগ করে তার খোঁজ নেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না।
ইসরাইলের সেনাবাহিনীর দেয়া হিসাবেই শনিবার পর্যন্ত গাজার ৬৫০টি টার্গেটে বিমান হামলা হয়েছে। অর্থাৎ সোমবার থেকে গড়ে প্রতিদিন এক শ’ থেকে দেড় শ’ বার ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমান গাজায় উড়ে গিয়ে বোমা ফেলছে। সেইসাথে চলছে সীমান্ত থেকে দূরপাল্লার কামানের গোলা।
গাজায় স্বাস্থ্য বিভাগের দেয়া হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দু‘শ’র কাছ্কাছি যার মধ্যে ৫২টি শিশু। ফলে, গাজার মতো অত্যন্ত ঘনবসতি একটি এলাকায় নির্বিচারে বোমা হামলা নিয়ে জাতিসঙ্ঘসহ বহু দেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
কিন্তু এখনও এসব নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই ইসরাইলের। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এখনো বলছেন, ‘যত দিন প্রয়োজন‘ গাজায় বিমান হামলা চলবে। এমনকি গাজায় স্থলবাহিনী ঢোকানোর সম্ভাবনাও নাকচ করছে না ইসরাইল।
প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক কোন প্রয়োজনের কথা বলছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী? গাজায় এ দফার এই সামরিক অভিযান থেকে কোন উদ্দেশ্য তারা হাসিল করতে চাইছে ইসরাইল?
ইসরাইলের নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা সংস্থা জেরুজালেম ইন্সটিটিউট অব স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড সিকিউরিটি‘র (জেআইএসএস) গবেষক ড. জনাথন স্পায়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, হামাসের ছোড়া রকেটের জবাব দিচ্ছে ইসরাইল, এবং এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে যাতে হামাস ভবিষ্যতে এমন সাহস না দেখায়।
‘আমি মনে করি ইসরাইল হামাসের রকেট নিক্ষেপের জবাবই দিচ্ছে। হামাসকে এমন একটি বার্তা দিতে চাইছে যে ভবিষ্যতে যেন এমন সাহস তারা না দেখায়। এছাড়া, গোপন জটিল কোনো উদ্দেশ্য ইসরাইলের আছে বলে মনে হয় না।’
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দেয়া হিসাবে হামাস গত সাতদিনে গাযা থেকে তেল আবিব সহ ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে প্রায় তিন হাজারের মত রকেট ছোঁড়া হয়েছে. যার আঘাতে মারা গেছে দশজন। রোববার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে তারা গাযায় হামাসের শীর্ষ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে টার্গেট করে এবং তার বাড়িতে বোমা হামলা চালানো হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, গত কয়েক দিনে হামাসের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতা মারা গেছেন।
ইসরায়েল কি তাহলে গাজা থেকে হামাসকে উৎখাত করতে চাইছে?
ড. স্পায়ার বলেন, তিনি মনে করেন না এই দফায় ইসরাইলের তেমন কোনো লক্ষ্য রয়েছে। সামরিকভাবে সেটা হয়তো ইসরাইলের পক্ষে সম্ভব, কিন্তু তার জন্য যে মূল্য দিতে হতে পারে ইসরাইল তার জন্য প্রস্তুত নয়।
তিনি বলেন, প্রথম কথা, হামাসকে গাজা থেকে সরাতে ইসরাইলকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যাপক মাত্রায় স্থল অভিযান চালাতে হতে পারে। তার অর্থ বহু প্রাণহানির আশঙ্কা, ইসরাইলি নাগরিকের প্রাণহানি ইসরাইলে খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়, রাজনীতিকরা সেই ঝুঁকি নিতে চান না।
তাছাড়া, ড. স্পায়ার বলেন, হামাসকে সরিয়ে দিলে গাজায় নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে তা নিয়ে ইসরাইল উদ্বিগ্ন। ইসরাইল নিজে আবারো গাজার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নিতে কোনোভাবেই চায় না।
অনেক পর্যবেক্ষকই বিশ্বাস করেন, হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া ইসরাইলের রাজনৈতিক স্বার্থেরও পরিপন্থী, কারণ হামাসের কারণেই ফিলিস্তিনিরা রাজনৈতিকভাবে এবং ভৌগোলিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত রয়েছে যা রাজনৈতিকভাবে ইসরাইলকে সুবিধা দিচ্ছে।
ইসরাইলের ‘ঘাস চাঁছা‘ কৌশল
ইসরাইলের প্রখ্যাত রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক এফরাইম ইনবার মনে করেন, ইসরাইল এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছে যে হামাস বা লেবাননের শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী হেযবোল্লার মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে নিশ্চিহ্ন করা হয়তো সম্ভব নয়, এবং সে কারণে ইসরাইল এসব গোষ্ঠীর ব্যাপারে, তার ভাষায়, ‘মোয়িং দি গ্রাস‘ অর্থাৎ ‘ঘাস চেঁছে রাখার’ কৌশল অনুসরণ করছে।
২০০২ সালে ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা, ২০০৬ সালে হিজবুল্লার সাথে যুদ্ধ এবং ২০০৬ এবং ২০০৮ সালে গাজায় হামাসের সাথে লড়াইয়ের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে ২০১৩ সালে তার এক গবেষণাপত্রে অধ্যপক ইনবার লেখেন- ‘ইসরায়েল মেনে নিয়েছে এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে তাদের লড়াই হবে দীর্ঘ ও জটিল। সাময়িক শক্তি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ও নিশ্চিত বিজয় সম্ভব নয়। ফলে মাঝেমধ্যে তীব্র শক্তি প্রয়োগ করে এসব শত্রুদের শক্তি কিছুটা খর্ব করার কৌশল তারা নিয়েছে যাতে কিছু দিনের জন্য তারা ঠাণ্ডা থাকবে, ইসরাইলের ওপর হামলা করতে ভয় পাবে এবং সীমান্ত কিছুদিন ঠাণ্ডা থাকবে।’
ড স্পায়ারও মনে করেন, ইসরাইল এবারো হামাসের ব্যাপারে ওই নীতিই অনুসরণ করছে এবং কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো এ দফার অভিযান বন্ধ হবে। ইতিমধ্যেই যুদ্ধবিরতি নিয়ে মধ্যস্থতার কথা উঠছে। আমেরিকা বলছে, মিসর বলছে। আমার মনে হয় আর খুব বেশি দিন এই অভিযান চলবে না। ড. মনে করেন, ইসরাইলি সরকার ও সেনাবাহিনী বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনের দাবি করবে।
‘এরই মধ্যে তারা ওই দাবি তুলতে শুরু করেছে। সেনাবাহিনী বলছে, গাজায় হামাসের টানেল নেটওয়ার্কের ব্যাপক ক্ষতি করা সম্ভব হয়েছে। হামাসের গোয়েন্দা তৎপরতার কেন্দ্র ছিল যে ভবনটি সেটি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে… আগামী ৭২ ঘণ্টায় আমরা আরো এমন বেশ কিছু সাফল্যের দাবি শুনবো।’
তবে, তিনি মনে করেন, প্রকৃতপক্ষে হামাসের শক্তি কতটুক কমবে, হামাস কত দিন রকেট ছোঁড়া থেকে নিবৃত থাকেবে তা বলা সম্ভব নয়।
‘আসল লড়াইয়ের পর শুরু হবে সাফল্য ব্যর্থতা নিয়ে পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যার লড়াই। আপনি হামাসের পক্ষ থেকে ভিন্ন ব্যাখ্যা শুনবেন। তারা বলবে ইসরাইল কিছুই করতে পারেনি।’
ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামাসের প্রভাব
গাজায় দিনের পর দিন বোমাবর্ষণ এবং বেসামরিক লোকজনের প্রাণহানি নিয়ে মুসলিমবিশ্বের ক্ষোভ এবং অস্বস্তি বাড়ছে।
সৌদি আরবের জেদ্দায় রোববার ইসলামি ঐক্য জোট বা ওআইসির একটি জরুরি বৈঠক হয়েছে। আল আকসা মসজিদ চত্বরে ইসরাইলি পুলিশের হামলা এবং তারপর গাজায় প্রাণহানির জেরে ‘আব্রাহাম চুক্তি‘ নামে পরিচিত যে শান্তিচুক্তি কয়েকটি আরব দেশের সাথে ইসরাইলের হয়েছে সেটি চাপের মধ্যে পড়বে বলে মনে করেন বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্রাঙ্ক গার্ডনার। মধ্যপ্রাচ্যের আরো অনেক বিশ্লেষকই সেই সম্ভাবনার কথা বলেছেন।
তবে ড. জনাথন স্পায়ার মনে করেন, আব্রাহাম চুক্তি ধসে পড়বে সে সম্ভাবনা তিনি এখনই দেখছেন না কারণ, তার মতে, ‘ঐ চুক্তির সাথে আরব ঐ দেশগুলোর নিজেদের অনেক স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে।’
তিনি মনে করেন, ইসরাইলের এখন প্রধান উদ্বেগ জাফা, আকর ও লোদের মতো আরব অধ্যুষিত বিভিন্ন শহরে চলা দাঙ্গা, যে ঘটনাকে গৃহযুদ্ধের হুমকি বলে বর্ণনা করেছেন ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট।
ড স্পায়ার বলেন, ‘এই দফার এই সংঘাতে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তা হলো হামাস এই প্রথম ইসরাইলের ভেতর আরব জনগোষ্ঠীকে খেপিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এটি এবার হামাসের বড় একটি কৌশলগত অর্জন এবং ইসরাইলের বড় মাথাব্যথার কারণ।’
তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ এই পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করতেই ইসরাইল হয়তো এখন যত দ্রুত সম্ভব গাজায় অভিযান বন্ধের তাড়না অনুভব করছে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply