করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে নানা নির্দেশনা জারি করেছে সরকার; আরোপ করেছে বেশকিছু বিধিনিষেধ। সরকারের এসব নির্দেশনা, আরোপিত বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই লাখ-লাখ মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছে আসন্ন ঈদ উপলক্ষে। দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ ও ট্রেন বন্ধ থাকায় বিকল্প বাহনে গাদাগাদি করে প্রতিদিনই রাজধানী ছাড়ছে মানুষ, করোনার মারাত্মক ঝুঁকি উপেক্ষা করে। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামমুখী হওয়ায় গ্রামাঞ্চলেও করোনা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও বরাবরই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন।
গত কয়েকদিন ধরেই ঢাকা থেকে বিভিন্ন ছোট যানবাহন, এমনকি মালবাহী ট্রাক বা পিকআপে চেপে খানিকটা পথ যাওয়ার পর নতুন কোনো বাহনে চেপে ছুটছে গ্রামের পানে। বিত্তশালীদের অনেকে অ্যাম্বুলেন্সে করেও গ্রামের পথ ধরছেন বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। উত্তরাঞ্চল, কি দক্ষিণাঞ্চল- রাজধানীতে বসবাসকারী সব অঞ্চলের মানুষই এখন গ্রামমুখী। গাদাগাদি করে এসব মানুষের উত্তাল পদ্মা পার হওয়া ঠেকাতে দিনের বেলায় ফেরি বন্ধ রেখে, এমনকি বিজিবি পর্যন্ত মোতায়েন করেও কাজ হচ্ছে না।
এমন প্রেক্ষাপটে গ্রামেও করোনা বিস্তারের বিষয়ে উদ্বিগ্ন খোদ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। গতকালও তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে আহ্বান জানিয়ে বলেন, ঈদে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য মহামারীর মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে ছোটাছুটি না করে যে যেখানে আছেন, সেখানে থেকেই উৎসব উদযাপন করুন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জানি, ঈদের সময় মানুষ পাগল হয়ে গ্রামে ছুটছে।
কিন্তু এই যে আপনারা একসঙ্গে যাচ্ছেন, এই চলার পথে ফেরিতে হোক, গাড়িতে হোক, যেখানে হোক- কার যে করোনা ভাইরাস আছে আপনি জানেন না। কিন্তু আপনি সেটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আপনার পরিবারের কাছে। মা, বাবা, দাদা, দাদি, ভাই, বোন- যেই থাকুক, আপনি কিন্তু তাকেও সংক্রমিত করবেন। তার জীবনটাও মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলে দেবেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঈদ ঘিরে সামনের দিনগুলোতে শহর ও গ্রামে করোনার সংক্রমণ আবার বাড়তে পারে। দেশে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির বড় কারণ হতে পারে রোজার ঈদ। করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও যারা ঈদ উপলক্ষে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। গ্রামে যাওয়ার পর তাদের নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করতে হবে, হাটেবাজারে যাওয়া বন্ধ রাখতে হবে এবং কারও লক্ষণ-উপসর্গ দেখা গেলে দ্রুত পরীক্ষা করতে হবে, পরীক্ষায় যাদের পজিটিভ পাওয়া যাবে তাদের আইসোলেশনে নেওয়া এবং তাদের সংস্পর্শে আসা মানুষগুলোকে কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। এগুলো করা গেলে অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গত বছর করোনার প্রথম ঢেউকালে গ্রামে করোনা সংক্রমণের প্রধান কারণ ছিল দুই ঈদ। মানুষ বিকল্প বাহনে গাদাগাদি করে গ্রামে পৌঁছে সেখানে করোনা ছড়িয়েছে। তখনো মানুষ সরকারি বিধিনিষেধ মানেনি। ফলে করোনা সংক্রমণ গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে গত বছরের ৮ মার্চ তিনজন করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। এর পর সংক্রমণ বাড়তে বাড়তে জুন-জুলাই মাসে সর্বোচ্চ চূঁড়ায় পৌঁছে। ওই সময়ে (পিকটাইম) একদিনে ৪ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হতো এবং প্রতিদিন গড়ে মারা যেতেন ৫০-৬০ জন। এর পর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে করোনার সংক্রমণ কমতে শুরু করে এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রোগী ৩০০ জনের নিচে নেমে আসে।
কিন্তু হঠাৎ মার্চ মাসের শুরু থেকে করোনার সংক্রমণ আবার বাড়তে থাকে এবং একদিনে রোগী শনাক্তের সংখ্যা সাড়ে ৭ হাজারের বেশি এবং একদিনে শতাধিক মানুষের করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর রেকর্ড হয়। সরকার করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ৫ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর পর তা বাড়িয়ে ১৬ মে পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। এমন বিধিনিষেধের কারণে আন্তঃজেলা বাস, রেল ও নৌ যান বন্ধ রাখা হয়। অথচ আসন্ন রোজার ঈদকে ঘিরে রেখে লাখ-লাখ মানুষ বিকল্প উপায়ে শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটছেন।
মানুষের বিশাল ঢল থামাতে মাওয়া ফেরিঘাটে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে গতকাল। তারপরও মানুষকে থামানো যাচ্ছে না। এর বাইরে অন্যান্য সব সড়কে মানুষ বিকল্প বাহনে গ্রামে যাচ্ছেন। এ যাতায়াতে বহু মানুষের সমাগম হওয়ায় সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ছে। এ ছাড়া যারা গ্রামে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে যারা করোনায় সংক্রমিত তাদের মাধ্যমে গ্রামে বসবাসরতরা সংক্রমিত হতে পারে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুস্তাক হোসেন বলেন, মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া-আসা করলে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। ঈদকে ঘিরে মানুষ যখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে সেখানে সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ছে। পরিবহনে গাদাগাদি করে যাওয়ার সময় সংক্রমণ হয়, একসঙ্গে বেশি মানুষের জমায়েত হলে সংক্রমণ হয়, বদ্ধ দোকানপাটে সংক্রমণ হয়, মসজিদে অনেক মানুষ মাস্ক ছাড়া একত্রিত হয়ে নামাজ আদায়কালে সংক্রমণ হয়। মানুষ যেভাবে গ্রামে যাচ্ছে তাতে সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি আছে। আবার যারা শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে সংক্রমিত থাকলে তাদের মাধ্যমে গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ড. মুস্তাক হোসেন বলেন, যারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছেন তারা সেখানে গিয়ে যেন বাড়ি থেকে বের না হয়। তাদের কেউ সংক্রমিত হয়ে থাকলেও তাদের কাছ থেকে অন্যরা যেন সংক্রমিত না হয়, সংক্রমিত হলে তারা যেন দ্রুত পরীক্ষা করান, পরীক্ষায় পজিটিভ রিপোর্ট পেলে তাদের হাসপাতালে যেতে হবে অথবা ঘরেই আইসোলেশনে থাকতে হবে। যারা গ্রামে যাবে তাদের নিজ নিজ জায়গায় অবস্থান করতে হবে, বাজারঘাটে যাওয়া বন্ধ রাখতে হবে, অন্য মানুষের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া যাবে না, যেখানে বেড়াতে গেছে সেই বাড়িতেই থাকতে হবে। এর সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। ঈদের জামাত যেন বদ্ধ জায়গায় না হয় এবং খেলা জায়গায় ছোট ছোট লাইন করে নামাজ আদায় করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, ঈদ উপলক্ষে অনেক মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন। যারা যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক করোনা রোগীও থাকবে, যারা করোনার সংক্রমণ গ্রামে নিয়ে যাবে। যারা সংক্রমিত হবেন তারা আবার অন্যদের সংক্রমণ করবেন। এর মধ্যে যদি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট থাকে, তখন দ্রুত সংক্রমণ ছড়ানো এ ভ্যারিয়েন্টটিরও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমি মনে করি, ঈদকে ঘিরে এই যে বহু মানুষের গ্রামমুখী যাত্রা, এতে করে সংক্রমণ আবার বেড়ে যেতে পারে।
ঈদকে ঘিরে সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাও। তারা বলছেন, ঈদের ছুটিতে যেভাবে মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছে, সেটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক, আশঙ্কাজনক। গতকাল রবিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিন ধরে শনাক্তের হার ১০ শতাংশের নিচে আছে। এটি একটি আশা জাগানিয়া খবর।
কিন্তু এ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কারণ নেই। ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে যে সংখ্যক মানুষ রাজধানী থেকে গ্রামের পথে ছুটছেন এবং পথে যে পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি, তা খুবই উদ্বেগের। তিনি বলেন, আমরা সবার প্রচেষ্টায় যে জায়গায় এসেছি, এখানে যদি শিথিলতা দেখানো হয়; গাদাগাদি করে যদি মানুষ এভাবে ভ্রমণ করতে থাকে তা হলে ঈদের পর যে কোনো সময় ভালো থেকে খারাপের দিকে চলে যেতে পারে। এ আশঙ্কা আমাদের আছে। আর আছে বলেই বিধিনিষেধের ওপর বারবার জোর দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দেশে শনাক্ত হয়েছে। সারাদেশেই এ নিয়ে সংশয় ও উদ্বেগ রয়েছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দেখা উচিত। ভয় না পেয়ে যদি সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করা যায় তা হলে আমরা যে এখন স্থিতিশীল জায়গায় এসেছি, সে অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হবে।
ভারতীয় যে ভ্যারিয়েন্টটি আমরা চিহ্নিত করেছি, আমরা মনে করি ভ্যারিয়েন্ট যা-ই হোক না কেন চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রায় কাছাকাছি থেকে গেছে। খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। আমরা সংক্রমণের এ শৃঙ্খল যদি ভেঙে দিতে না পারি, আজ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এসেছে, কাল নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যাবে। আমাদের রোগীর সংখ্যা কিন্তু কমবে না। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, উপকরণ, জনবল কিন্তু অসীম নয়।
Leave a Reply