‘আমাদের ঘরেও মরণ, বাইরেও মরণ। বাইরে বার হইলে মরব করোনায়; ঘরে থাকলে মরব অনাহারে।’ মুকুল আহমেদের লেখাপড়ার দৌড় নাই বললেই চলে। পেশায় দিনমজুর। রাজধানীর মানিকনগরে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। করোনার খড়্গ তাকে কীভাবে কতটা চেপে ধরেছে, সে কথা বলতে গিয়েই আক্ষেপের সঙ্গে জানালেন যাপিত জীবনের কষ্টের কথা।
শুধু মুকুল আহমেদই নন, তার মতো নিম্নআয়ের মানুষজনের জন্য এখন জীবনযাপন করাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এবার আসছে সারাদেশে সাত দিনের জন্য কঠোর লকডাউন; চলবে ১৪ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত। এ সময়ে জরুরি সেবা ছাড়া সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শিল্পকারখানা, মার্কেট-দোকানপাট, যানবাহনসহ সবকিছু বন্ধ রাখার চিন্তা করা হয়েছে।
কিন্ত গেল লকডাউনের ঘাটতি কাটিয়ে উঠার আগে ফের লকডাউনের সিদ্ধান্তে অনেকটা চোখে অন্ধকার দেখছেন নিম্ন এমনকি মধ্যম আয়ের মানুষও। সর্বাধিক বিপদে আছেন খেটে খাওয়া মানুষজনসহ অতিদরিদ্ররা। তাদের কাছে, করোনার চেয়েও বড় মহামারী লকডাউন। কারণ এ সময় তারা পুরোপুরি আয়শূন্য হয়ে পড়েন। সঞ্চয় না থাকায় অনাহারে কাটে অনেকের সংসার। লকডাউনের খবরে ইতোমধ্যেই তাদের মাঝে দেখা দিয়েছে হতাশা।
করোনার ভয় থাকলেও পরিবার পরিজনের খাবার জোগান নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার ঘোষণাকালে এসব গরিব মানুষের কথা ভাবা হয়নি। বিবেচনায় নেওয়া হয়নি ক্ষুধা যে করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর। খাদ্যের জোগান দিতে না পারলে গরিব মানুষকে যে ঘরে রাখা যাবে না, তা ভাবা হয়নি। তারা বলছেন, লকডাউনের ঘোষণায় সামগ্রিক পরিকল্পনার কোনো ছাপ নেই, অন্তত দৃশ্যমান নয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক নাজনীন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, লকডাউন ঘোষণা করলেই তো আর বিপদ কেটে যায় না। হয়তো করোনার সংক্রমণ কমবে। কিন্তু এতে অসংখ্য দরিদ্র পরিবারের জীবনধারণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পরিবারে সন্তান যখন অনাহারে কাঁদে তখন দরিদ্র বাবার কাছে খাবার জোগাড় করাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। তাই কড়াকড়ি লকডাউনের আগে এসব পরিবার কীভাবে খেয়েপরে বাঁচবে তা ঠিক করতে হবে। তাদের কাছে কীভাবে খাদ্য সহায়তা কিংবা আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া যায়, তা ভাবতে হবে। এসব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
এ গবেষক আরও বলেন, যে ক’দিনের লকডাউন দিলে সত্যিকার অর্থেই তা করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় কার্যকর হবে, ততদিন পর্যন্ত লকডাউন দেওয়ার সক্ষমতা না থাকলে অল্প দিনের লকডাউন দিয়ে জীবনেরও তেমন লাভ হবে না, জীবিকাও হবে ক্ষতিগ্রস্ত। তখন করোনার সঙ্গে সঙ্গে অভাবে পড়েও মানুষের জীবনের ঝুঁঁকি বাড়তে পারে। এগুলো ভেবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এবার কেবল দরিদ্ররাই না, মধ্যবিত্তরা পর্যন্ত আতঙ্কে রয়েছেন উল্লেখ করে নাজনীন বলেন, গতবার সব পুঁজি ভেঙে এসব পরিবার টিকে ছিলেন। এখন অর্থনৈতিকভাবে অভাবে রয়েছেন মধ্যবিত্তরাও। তার ওপর কতদিন লকডাউন থাকবে তা জানা না থাকায় প্রস্তুতিও নিতে পারছেন না তারা। এমন পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা আরও বাড়ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার কারণে গত বছর ৭০ শতাংশ চাকরিজীবীর আয় কমে গেছে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এক যৌথ জরিপে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের নভেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের নভেম্বরে জরিপকৃত চারটি জেলায় মজুরি বা বেতনভুক্ত কর্মচারী বা কর্মকর্তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশের আয় কমেছে, ২৮ শতাংশের আয়
অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ২ শতাংশের আয় বেড়েছে। স্বকর্মসংস্থানে নিয়োজিতদের মধ্যে এ সময়কালে লাভ কমেছে ৮২ শতাংশের, অপরিবর্তিত রয়েছে ১৫ শতাংশের এবং বেড়েছে ৩ শতাংশের। স্বকর্মসংস্থানে নিয়োজিত এ চারটি জেলায় করোনার সময়ে ব্যবসা বা অর্থনৈতিক কর্মকা- সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হয়েছে ৩১ শতাংশের।
গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক জরিপে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফরম, বাংলাদেশ জানিয়েছে, প্রায় ৭৯ শতাংশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এখনো গত বছরের করোনার আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেনি। করোনার ক্রান্তিকালে এ প্রান্তিক শ্রেণির ৮০ শতাংশ পরিবার খাদ্য কেনার পেছনে খরচ কমিয়েছে অর্থাৎ তারা খাদ্য গ্রহণে পর্যন্ত রাশ টেনে ধরতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়া ৬৪ শতাংশের বেশি খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, লকডাউনের সময় মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার (র্যাব, পুলিশ, আনসার) মাধ্যমে বস্তিবাসী এবং নিম্নআয়ের মানুষদের খাবার পৌঁছাতে হবে। পাশাপাশি রাস্তার মানুষদেরও খাবার দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, হাসপাতাল, আইসিইউ, অক্সিজেন সেবা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে যাতে মানুষ সেবা পান এজন্য এসব হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় কমাতে হবে।
জানা গেছে, গত বছর করোনা মহামারীর শুরুর দিকে ‘সাধারণ ছুটি’র মোড়কে চলা লকডাউনে সারাদেশে ব্যাপকভাবে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। এমনকি ব্যক্তি উদ্যোগেও বিতরণ করা হয় খাদ্যসামগ্রী। সরকারি ত্রাণসামগ্রীর অপ্রতুলতা তাই খুব একটা আঁচ করা যায়নি। কিন্তু এবার এসব ব্যক্তি ও সংগঠন কতটা এগিয়ে আসবে, এ নিয়েও সংশয় রয়েছে।
মুগদা এলাকার বাসিন্দা পেশায় রাজমিস্ত্রি ইমরান আহমদ বলেন, ‘কিছুই বুঝতে পারছি না। গত লকডাউনের ঋণ এখনো শেষ করতে পারিনি। এর মাঝে আবার লকডাউন। আবার সামনে লকডাউনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সামনে খুব খারাপ অবস্থা দেখছি। তিনি বলেন, প্রথম লকডাউনে বিভিন্ন দিক থেকে কিছু সহায়তা মিলেছে। কিন্তু এবার তাও মিলছে না। মানুষ কতো দেবে?
মতিঝিলের ফুটপাতের ব্যবসায়ী নাছির উদ্দিন বলেন, লকডাউনে গরিবের যত সমস্যা। ফুটপাতে ব্যবসা করে সংসার চালাই। দোকান না খুললে আমাদের পেটে ভাত পড়ে না। লকডাউনে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে কীভাবে খাব, কোথায় যাব আল্লাই জানে।
নতুন করে (লকডাউন) নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন মুকুল, ইমরান ও নাছিরের মতো নিম্নআয়ের মানুষেরা; দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ ও বস্তিবাসী। তাদের তাৎক্ষণিক সহায়তা, খাদ্যের জোগান দেওয়া বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি সরকারি ঘোষণায়। অন্যদিকে বাজারে সব জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। চাল, ডাল, তেল, আটার মতো অত্যাবশকীয় পণ্যের দামও এখন দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে। ক্ষুধা নিবারণে দরিদ্রের শেষ ভরসা একমুঠো ভাত। সে জন্য অত্যল্প দামের যে মোটা চাল, তাও এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে।
এমন পরিস্থিতিতে কড়াকড়ি লকডাউন হলে আয়শূন্য হয়ে পড়ার চাপ অনেক পরিবারই সামলাতে পারবে না বলে আশঙ্কা বাজার বিশ্লেষকদের। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনসাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, আমরা সিপিডি, সানেমের প্রতিবেদনে দেখেছি যে, করোনাকালে দেশে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছেন। অন্যদিকে অতিদরিদ্র্যের সংখ্যাও বেড়েছে। সামনে আসছে কড়াকাড়ি লকডাউন।
সুতরাং অসংখ্য পরিবার এসময় খাদ্য সংকটের মধ্যে পতিত হবেন। এদিকটা সরকারের নজর দিতেই হবে। দরিদ্রসহ অর্থনৈতিকভাবে বিপদে পড়া পরিবারগুলোর জন্য যেভাবেই হোক খাবারে সুব্যবস্থা করতে হবে। এদিকে লকডাউন ও করোনা মহামারীর সময়ে শ্রমজীবীদের রেশন দেওয়া ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)। গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত এক বিক্ষোভ
সমাবেশে তারা জানান, গত এক বছরে করোনা মহামারীর কারণে দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। অনেক শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। যারা ঢাকা ছেড়েছিলেন তারা এখনো ফিরে আসেননি। মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিনযাপন করছে। করোনা থেকে বাঁচলেও মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। বিগত করোনা ও লকডাউনের সময়ে সরকারের দেওয়া সাহায্য দলীয় লোকেরা লুটপাট করেছে। শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ কোনো সাহায্য পায়নি।
উদ্যোগ
মহামারী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বিধিনিষেধ আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের জন্য ৫৭২ কোটি ৯ লাখ ২৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। করোনার এ তীব্র সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে গত ৫ এপ্রিল থেকে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। এ সময় কর্মহীন হয়ে যাওয়া মানুষের সহায়তায় আর্থিক সহায়তা বরাদ্দ দেয় সরকার।
তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, ভিজিএফ (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) কর্মসূচির আওতায় এ আর্থিক সহায়তায় পরিবারপ্রতি ৪৫ টাকা কেজি দরে ১০ কেজি চালের সমমূল্য, অর্থাৎ কার্ডপ্রতি ৪৫০ টাকা দেওয়া হবে। জানা গেছে, দেশের ৬৪টি জেলার ৪৯২টি উপজেলার জন্য ৮৭ লাখ ৭৯ হাজার ২০৩টি কার্ড এবং ৩২৮টি পৌরসভার জন্য ১২ লাখ ৩০ হাজার ৭৪৬টি কার্ডসহ মোট এক কোটি ৯ হাজার ৯৪৯টি ভিজিএফ কার্ডের বিপরীতে ৪৫০ কোটি ৪৪ লাখ ৭৭ হাজার ৫০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পরিবারপ্রতি ১০ কেজি চালের সমমূল্য, অর্থাৎ কার্ডপ্রতি ৪৫০ টাকা হারে এ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া করোনাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য সহায়তার জন্য ১২১ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। ৬৪টি জেলার ৪ হাজার ৫৬৮টি ইউনিয়নের প্রতিটিতে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা হারে মোট ১১৪ কোটি ২০ লাখ টাকা মানবিক সহায়তা দেওয়া হবে।
সারাদেশের ৩২৮টি পৌরসভার অনুকূলে মোট ৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরির প্রতিটি পৌরসভার জন্য ২ লাখ টাকা, ‘বি’ ক্যাটাগরির প্রতিটি পৌরসভার জন্য এক লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রতিটি পৌরসভার জন্য এক লাখ টাকা হারে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর, গাজীপুর এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জন্য ৭ লাখ টাকা হারে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের জন্য ৫ লাখ টাকা হারে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের ৬৪টি জেলার জেলা প্রশাসনের অনুকূলে ‘এ’ ক্যাটাগরির জন্য ২ লাখ টাকা ‘বি’ ক্যাটাগরির জন্য এক লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ‘সি’ ক্যাটাগরির জন্য এক লাখ টাকা হারে মোট এক কোটি ৭৭ লাখ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
Leave a Reply