হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সাম্প্রতিক ‘লাগামহীন’ বক্তব্য ও ‘বিতর্কিত’ কর্মকাণ্ডে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিগত দিনে ছাড় পেলেও এবার সংগঠনটির নেতাদের তীক্ষ্ণ নজরে রাখা হয়েছে। তবে হামলার বদলে হামলা নয়, বরং প্রচলিত আইনে তাদের মামলার তীরে বিদ্ধ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীনরা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের ভাষ্য, হেফাজত রাজনৈতিক সংগঠন না হয়েও সম্প্রতি তারা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ নিয়েই মাঠে নেমেছে। এর জন্য তারা পবিত্র ধর্মকেও ব্যবহার করছে। আর এ সত্যটা আওয়ামী লীগের বাইরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও মানছে। পাশাপাশি চিন্তার মিল না থাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গেও কমছে হেফাজতের বোঝাপড়া। তাই এ সময়টাকে উপযুক্ত মনে করেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।
দলীয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাদের ‘অতি উৎসাহী’ অবস্থানের কারণে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েতে হয়েছে। আবার কোন্দলের কারণে নোয়াখালী, কুমিল্লা, রাজবাড়ী, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মবাণবাড়িয়াসহ দেশের প্রায় সব সাংগঠনিক এলাকায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে চলছে আওয়ামী লীগ। ফলে হেফাজতের ইস্যুটা ব্যবহার করে দলের কেউ নিজস্ব বলয় তৈরির চেষ্টা করতে পারেন- এমন খবরও রয়েছে শীর্ষ মহলে।
দল ক্ষমতায় থাকার পরও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর, সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দলীয় ও সরকারি অফিসে হামলা, বিগত দিনের রেকর্ড ভেঙে নারায়ণগঞ্জে হেফাজতের হামলা, আওয়ামী লীগের ঘাঁটিখ্যাত কিশোরগঞ্জে দলীয় অফিসে হামলা-ভাঙচুর ঠেকাতে না পারার জন্য দলের নেতাকর্মীদের স্থবিরতা ও অন্তর্কোন্দলকেই দায়ী করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
অন্যদিকে হেফাজত ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়েও সংশয় রয়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের। তারা বলছেন, ২০১৪ সালের ৫ মে সরকার পতনের আন্দোলন, পরে সুপ্রিমকোর্টের সামনে থেকে গ্রিক দেবী এবং সর্বশেষ ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য অপসারণে বিক্ষোভ দেখানোর পর হেফাজতের বিষয়ে কেন্দ্র শিথিলতা দেখিয়েছে। নানা ইস্যুতে ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের সমন্বয়হীনতার সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে হেফাজত- এমনটাও উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। তবে এবার আর কোনো অবস্থাতেই ছাড় নয়, হেফাজতকে কঠোর প্রতিরোধের ঘোষণা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের। ‘যেখানেই ধর্মের নামে অধর্ম ও সহিংসতা হবে, সেখানেই প্রতিহত করা হবে’- এমন হুশিয়ারিই দিচ্ছেন তারা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গেল বুধবার নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, ‘সন্ত্রাস, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উসকানিদাতাদের তালিকা প্রস্তুত করে এদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। হেফাজতে ইসলাম নামে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দেশের বিদ্যমান স্বস্তি ও শান্তি বিনষ্ট করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে অব্যাহত তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে, তা সহনশীলতার সব মাত্রা অতিক্রম করেছে। জনগণের জানমালের সুরক্ষা দিতে শেখ হাসিনা সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশব্যাপী তাণ্ডবকারীদের সতর্ক করে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘দেশের জনগণের ধৈর্য ও সহনশীলতার একটা সীমা আছে। সীমা অতিক্রম করলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আছেন বলেই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ধ্বংসাত্মক রাজনীতির বিপরীতে আওয়ামী লীগ এখনো দায়িত্বশীল আচরণ করছে, দেখাচ্ছে সহনশীলতা। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, কোনো ধর্মান্ধতাকে সমর্থন দেয় না। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, আগুন নিয়ে খেলবেন না। আগুন নিয়ে খেলতে গেলে সে আগুনে আপনাদের হাত পুড়ে যাবে। যারা তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে করোনা ভাইরাস ব্যাপক আকার ধারণ করায় সরকার কঠোর বিধিনিষেধের পর লকডাউনের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশে সব ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ থাকায় হেফাজত ইস্যুতে প্রতিবাদ সমাবেশ বা প্রতিরোধে যেতে পারছে না আওয়ামী লীগ। তাই আপাতত রাজনৈতিকভাবে নয়, রীতি অনুযায়ী আইনিভাবে হেফাজতকে মোকাবিলা করবে দলটি। সে অনুযায়ী, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বায়তুল মোকাররমে ভাঙচুরের ১০ দিন পর গত ৫ এপ্রিল রাজধানীর পল্টন থানায় একটি মামলা করেন যুবলীগ নেতা খন্দকার আরিফুজ্জামান। আসামি হিসেবে হেফাজতে ইসলামের বহুল আলোচিত নেতা মাওলানা মামুনুল হকসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করেন তিনি। মামলার এজাহারে বলা হয়, মামুনুল হকের প্রত্যক্ষ নির্দেশে পূর্বপরিকল্পিতভাবেই বায়তুল মোকাররমে মুসল্লিদের ওপর হামলা করা হয়। এ সময় হামলাকারীদের সঙ্গে ছিল রিভলবার, দেশীয় অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র. দা, ছোড়া, তলোয়ারসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র।
মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় গত বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারি করায় পিছু হটে হেফাজতে ইসলাম। ‘শিশুবক্তা’ হিসেবে পরিচিত হেফাজত নেতা রফিকুল ইসলাম মাদানীকেও এরই মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। হাটহাজারী থানা ভাঙচুরের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে চারজনকে।
এ ছাড়াও ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় যারা ইসলামিক বক্তব্য দিচ্ছেন, তাদেরকেও নজরদারিতে রেখেছে প্রশাসন। ধর্মীয় বক্তব্যের নামে প্রতিহিংসা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করলেই আইসিটি অ্যাক্টসহ প্রচলিত অন্যান্য আইনানুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এরই মধ্যে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের নেতৃত্বে সোনারগাঁও ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া, প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল ফারুক খানের নেতৃত্বে ফরিদপুর এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতারা পরিদর্শন করেছেন সুনামগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। হেফাজতসহ আওয়ামীবিরোধী সব শক্তিকে হুশিয়ারি দিয়ে তারা বলেন- যারা মানুষের ঘর পোড়ায়, সাংস্কৃতিক সংগঠন ভাঙচুর করে, জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে আঘাত করে; তারা স্বাধীনতাবিরোধীদেরই উত্তরসূরি। তাদের আর ছাড় দেওয়া হবে না, আইনিভাবে ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হবে।
দলীয় সূত্র জানায়, যেখানেই কেউ ধর্মের অপব্যাখ্যা দিবে বা ধর্মকে ব্যবহার করে অন্যায় আচরণ করবে, তাদের তালিকা করার জন্য আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। দলের শীর্ষপর্যায়ের অনুমতিক্রমে তারা বিতর্কিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করবেন। একই সঙ্গে দলের বুদ্ধিদীপ্ত নেতাকর্মীদের দিয়ে গুজব প্রতিরোধ ও বিতর্কিত ব্যক্তির কর্মকা- যুক্তি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্রকাশনার মাধ্যমে তুলে ধরবে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ আমাদের সময়কে বলেন, ‘হেফাজত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়, এটি সন্ত্রাসী সংগঠন। সন্ত্রাসীদের তো আইনিভাবেই দমন করতে হয়। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এদের দমন করা হবে।’
Leave a Reply