ধর্ষণ মামলার বিচার তদারকিতে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদারকি/মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হচ্ছেন-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম বা তার প্রতিনিধি (অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার নিচে নয়) এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব বা তার প্রতিনিধি (অতিরিক্ত সচিব পদ-মর্যাদার নিচে নয়)। সেল গঠন সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের বেঞ্চে দাখিল করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা আইনে নির্ধারিত ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ওই সেল গঠনের নির্দেশ দিয়ে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ। ওই রায় অনুযায়ী এই মনিটরিং সেল আইনে নির্ধারিত ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি না হওয়া নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলার বিষয়ে বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তার পাঠানো প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে অধস্তন আদালত সংক্রান্ত সুপ্রিমকোর্টের কমিটির কাছে প্রতিবেদন দেবে। প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে সুপ্রিমকোর্টের ওই কমিটি মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩১ (ক) (৩) ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেবে। মূলত গাফিলতি এড়িয়ে ধর্ষণ মামলার বিচারে গতি আনতে এই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
এই রায়টিসহ ধর্ষণ মামলার বিচারের বিষয়ে হাইকোর্টের দেওয়া তিনটি রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়ন এবং ধর্ষণের মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা, সালিস বা মীমাংসা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে গত বছরের ১৯ অক্টোবর হাইকোর্টে রিট করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ২১ অক্টোবর হাইকোর্ট রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন। আদেশে সেদিন হাইকোর্ট ধর্ষণের ঘটনায় মধ্যস্থতা, সালিশ বা মীমাংসা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনায় গত পাঁচ বছরে সারা দেশের থানা, আদালত ও ট্রাইব্যুনালে কতগুলো মামলা হয়েছে, তা জানিয়ে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি, বিচার শুরুর পর থেকে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত একটানা বিচার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হাইকোর্টের দেওয়া আগের নির্দেশনা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তার অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। চার মাসের মধ্যে এই প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। সে অনুসারে পুলিশপ্রধান (আইজিপি) ও সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের পক্ষে পাঠানো পৃথক দুটি প্রতিবেদন গতকাল রাষ্ট্রপক্ষ আদালতের কাছে তুলে ধরে।
পুলিশ মহাপরিদর্শকের পক্ষ থেকে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৫ বছরে শুধু সারাদেশের থানাগুলোতে ২৬ হাজার ৬শ ৯৫টি ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। পুলিশপ্রধানের পক্ষে অতিরিক্ত ডিআইজি মো. রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত পুলিশ সদর দপ্তরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট শাখা থেকে ধর্ষণ মামলার পরিসংখ্যানটি পাঠানো হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ৪৩৩১টি, ২০১৭ সালে ৪৬৮৩টি, ২০১৮ সালে ৪৬৯৫টি, ২০১৯ সালে ৬৭৬৬টি এবং ২০২০ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৬২২০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি বছরই ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়েরের পরিমাণ বেড়েছে।
তবে আদালতগুলোতে কি পরিমাণ ধর্ষণের মামলা হয়েছে সেই তথ্য এখনো হাইকোর্টে পৌঁছায়নি। তবে হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো: গোলাম রাব্বানী স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ষণের মামলা ১৮০ কার্যদিবসে বিরতিহীনভাবে নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, তা মনিটরিং করতে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবরকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চে এই তথ্য সংবলিত পৃথক দুটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ মো. রাসেল চৌধুরী। আবেদনকারী পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট ইয়াদিয়া জামান ও অ্যাডভোকেট শাহিনুজ্জামান শাহিন। পরে আইনজীবী ইয়াদিয়া জামান জানান, ‘ধর্ষণের মামলার তথ্য সংবলিত প্রতিবেদন পুলিশের পক্ষ থেকে এসেছে। তবে আদালতগুলোতে কতগুলো ধর্ষণের মামলা হয়েছে সেই তথ্য এখনো আসেনি। আদালত এ কারণে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৩ মে পরবর্তী তারিখ রেখেছেন।’
গতকাল শুনানিতে আইজিপির প্রতিবেদনের অংশবিশেষ তুলে ধরে আইনজীবী অনীক আর হক আদালতে বলেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী ধর্ষণের ঘটনা প্রতিবছর বাড়ছে। থানায় ৫ বছরে ২৬ হাজার ৬৯৫টি মামলা হয়েছে। তার বাইরে ট্রাইব্যুনালেও মামলা হয়। বাকিদের কাছ থেকে প্রতিবেদন আসেনি। সুপ্রিমকোর্টের প্রতিবেদন তুলে ধরে আইনজীবী অনীক আর হক বলেন, হাইকোর্টের ইতিপূর্বের রায়ের নির্দেশনা অনুসারে মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। গত ১৮ নভেম্বর এই সেল গঠন করা হয়। হাইকোর্টের তিনটি রায় ছিল। এসব রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ আদালতের আদেশের পরই তা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও ব্লাস্টসহ পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠনের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮ দফা নির্দেশনাসহ রায় দেন হাইকোর্ট। আদালতের ঐ নির্দেশনায় বলা হয়, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা এ সংক্রান্ত ঘটনায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ লিখিতভাবে রেকর্ড করবেন? এ ক্ষেত্রে ওই থানার আওতার মধ্যে ঘটনা সংঘটিত হোক-বা-না-হোক, সেটা মুখ্য নয়? অবিলম্বে এমন একটি সার্ভার তৈরি করতে হবে, যেন এ ধরনের অভিযোগ সরাসরি অনলাইনের মাধ্যমে করা যায়? সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনো পুলিশ অফিসার যদি অভিযোগ গ্রহণে বিলম্ব করেন, তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুনির্দিষ্ট বিধান তৈরি করতে হবে?
নির্দেনায় আরও বলা হয়, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নমূলক ঘটনায় অভিযোগ পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হবে। একইসঙ্গে এ ধরনের ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএসহ অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ করে তা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাতে হবে। এছাড়া যেকোনো রিপোর্ট সংগ্রহ বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থার যেকোনো ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি দ্রুত মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে?
একই বছরের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট এক আদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা নির্ধারিত ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ না হলে জবাবদিহি-সংক্রান্ত আইনের ৩১ক ধারা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে বলেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তাকে (পুলিশ) এ নির্দেশ দেন আদালত। এ বিধান যথাযথভাবে প্রতিপালন করা না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয় আদেশে।
সর্বশেষ আইনে নির্ধারিত সময়ে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ না হওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করে গত বছরের ১৮ জুলাই হাইকোর্ট ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সাত দফা নির্দেশনা দেন। এর মধ্যে আইনে নির্ধারিত সময়সীমা অর্থাৎ বিচারের জন্য মামলা হাতে পাওয়ার দিন থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার বিচার শেষ করতে হবে এবং মামলার শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা মামলা পরিচালনা করতে মামলায় সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে তদারকি কমিটি গঠন করতে হবে উল্লেখযোগ্য।
রিটকারীর আইনজীবীর ভাষ্য, ধর্ষণের ঘটনায় আইনি বিধিবিধান অনুসরণ ও ভুক্তভোগীর সুরক্ষা এবং যথাযথ প্রতিকার নিশ্চিতে ইতিপূর্বে হাইকোর্ট তিনটি মামলায় রায় দেন। তবে রায়ের নির্দেশনার বাস্তবায়ন দেখা যায় না। এমন প্রেক্ষাপটে রিটটি করা হয়।
Leave a Reply