অবৈধ আয়ের দুষ্টচক্র না ভেঙ্গে শুধু কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া অর্থনীতির জন্য সুফল আনবে না। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থনীতির জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতির মৌল সহায়ক নৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকাটাই হবে অর্থনীতি ভালো থাকতে দেয়ার অন্যতম উপায়।
সংলাপে বলা হয়, কালো টাকা সাদা করার মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা না করাই সমীচীন। রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত দুর্নীতিজাত অনুপার্জিত আয়ের উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা। দুর্নীতিজাত কালো টাকা লালন থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের মুক্তি মিলবে না। অভ্যন্তরীণ সহনশীল ক্ষমতা ও জনগণের আন্তঃশক্তির কারণেই বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো স্ট্রোক করছে না। কিন্তু এটাকে আত্মতুষ্টি হিসেবে ধরে নেয়া ঠিক হবে না।
সংলাপে বক্তারা বলেন, সৎ ও নিয়মিত করদাতারা ১৫-২৫ শতাংশ কর দেবেন, আর কালো টাকার মালিকরা ১০ শতাংশ কর দিয়ে টাকা সাদা করতে পারবে, এ নীতির সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। এ ধারা অব্যাহত থাকলে কর রাজস্ব আহরণের নৈতিক দাবি দুর্বল হবে এবং সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে পড়ে থাকার অনেক কারণের মধ্যে অনৈতিক নীতির পরিপোষণও একটি। এমতাবস্থায় ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র প্রবণতায় কালো টাকা সৃষ্টির প্রেরণা ও প্রযত্ন প্রদানের নীতি সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য।
সংলাপে বলা হয়, আর্থিক দুর্বৃত্তায়নের ভয়াবহ বেড়াজাল থেকে আইনের আওতায় ‘মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ, ঘুষখোর সুশীল সেবক (আমলা) এবং মুনাফাবাজ/কালোবাজারি/চোরাকারবারি/ব্যাংকঋণ লুটেরা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের’ অপরাধের শাস্তি বিধান করা হলে সমাজ ও অর্থনীতিতে একটা ইতিবাচক ম্যাসেজ যাবে। জরিমানা ছাড়া, অত্যন্ত হ্রাসকৃতহারে কর প্রদানের সুযোগ এবং ‘অর্থের উৎস নিয়ে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবেন না’- এ জাতীয় বিধান বলবৎ থাকলে তা দেশ সমাজ ও অর্থনীতিতে নৈতিক বিপদ ডেকে আনবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে অনেক দিন ধরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকলেও চলতি অর্থবছরে এ সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করেছেন ৭ হাজার ৪৪৫ জন করদাতা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। এর বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৯০০ কোটি টাকা। কারো কারো মতে, চলতি বছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় সম্পর্কিত আইনে পরিবর্তন আসায় করদাতারা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করতে উৎসাহিত হয়েছেন। সংলাপে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতিতে দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার অনেকখানি বিঘ্নিত ও শ্লথ হয়ে পড়ায় কালো টাকার মালিকরা তাদের কালো টাকার একটা অংশ ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করে দেশের রিয়েল এস্টেট, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, শেয়ারবাজার ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ করছে। একই সাথে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স প্রবাহের ঢল প্রমাণ করছে যে, হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি পাচার শ্লথ হয়ে পড়েছে। এ অভূতপূর্ব রেমিট্যান্সের জোয়ার দেশের অর্থনীতিকে মহামারীর নেতিবাচক অভিঘাত থেকে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে।
সংলাপে অংশ নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া নিয়ে বিধিব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সামাজিক অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রের এখতিয়ার।
সাবেক এনবিআর সদস্য (শুল্কনীতি) মো: ফরিদ উদ্দিন বলেন, টাকা আয়ের মূল কারণ হলো সুশাসনের অভাব। কালো টাকা রোধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
এনবিআর সদস্য (আয়কর নীতি) মো: আলমগীর হোসেন বলেন, অপ্রদর্শিত আয় মূল ধারায় নিয়ে আসার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ কর সুবিধার মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুবিধা দেয়া হলে তা সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নয়নে সাহায্য করবে।
এর জবাবে সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান ‘বিশেষ কর সুবিধা’র সুফল নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, এ ধরনের সুবিধা সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে। বিশেষ কর সুবিধা সত্যিই অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক কিনা, এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গবেষণা করা দরকার।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অন্যায্য বোধকে প্রশ্রয় দেয়। সীমিত আকারে ও স্বল্প সময়ের জন্য এই সুযোগ অর্থনীতির জন্য সহায়ক হলেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বর্তমান কালো টাকা সাদা করার সুযোগের চেয়ে সৎভাবে কর দেয়া বেশি ব্যয় বহুল। এই সুযোগের কারণে মানুষ সৎভাবে কর দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারে।
‘কালো টাকা সাদা করার উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ’ বলে মত ব্যক্ত করেন মাল্টিমোড গ্রুপের পরিচালক তাবিথ আউয়াল। বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) প্রেসিডেন্ট কামরান টি রহমান বলেন, কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত আয়ের পার্থক্য স্পষ্টভাবে দেখানো দরকার। সংলাপে গণমাধ্যমকর্মীরাও অংশগ্রহণ করেন।
Leave a Reply