বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে বিশ্বদরবারে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জো বাইডেন গতকাল দেশটির ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তার সঙ্গে দেশটির ইতিহাসে প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ও প্রথম এশীয়-মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস। ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের নেতৃত্বে যে ‘বিদ্বেষবাষ্প ও অস্বস্তি’ ঘরে-বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল, বাইডেনের নেতৃত্বে সেই আঁধার দূর হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ‘নতুন ভোর’ দেখা যাবে বলেই মনে করছে দেশটির ইউরোপীয় মিত্ররা।
নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মার্কিন সংসদ ভবনের সামনে শপথ নিয়েছেন বাইডেন ও কমলা। ঠিক দুই সপ্তাহ আগে তার পূর্বসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকরা এই ক্যাপিটলেই সশস্ত্র দাঙ্গা বাঁধিয়েছিল। আর এ কারণে ক্যাপিটল ভবনের চারধারে এত বেশি সেনা ও নিরাপত্তাকর্মী নামানো হয়েছিল যে, স্থানীয়রা একে ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ বলে অভিহিত করেন।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮৯৩ সালের পারিবারিক বাইবেল ছুঁয়ে শপথ নিয়েছেন বাইডেন। প্রথা মেনে শপথে তিনি বলেন, ‘আমি শপথ করছি যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালন করব। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাব।’
শপথ পরবর্তী প্রথম বক্তৃতায় বাইডেন বিদ্বেষ-বিভাজন ভুলে গিয়ে ভালোবাসা ও ঐক্য গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামনে ঐক্যই সফল হওয়ার একমাত্র পথ। তিনি বলেন, আমাদের জন্য এ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, বিশেষত সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়। তিনি স্বীকার করে নেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিভাজনের যে দেয়াল গড়ে উঠেছে সমাজের পরতে পরতে- এর শেকড় গভীরে এবং এটা অবাস্তব কিছু নয়, নতুনও নয়। কিন্তু তিনি মনে করেন, ‘ঐক্যই সামনে আগানোর উপায়।’
যুক্তরাষ্ট্র ‘প্রতিনিয়ত সংগ্রাম’ করে এগুচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসের শপথ এটাই প্রতীয়মান করে যে, এই জাতি কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করতে পারে। জনতার উদ্দেশে বাইডেন বলেন, ‘কিছুই বদলানো যায় না, এ কথা আমাকে দয়া করে বলবেন না।’ তিনি যোগ করেন, ভোটে যারা আমাকে সমর্থন দিয়েছেন তাদের জন্য যেমন, ঠিক তেমনই যারা সমর্থন করেননি, সেই বিরোধীদের জন্যও আমি সমানভাবে লড়াই চালিয়ে যাব। তিনি পুণরায় স্পষ্ট করে বলেন, আমি আমেরিকার সব মানুষের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করব।
শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি আমান্ডা গরম্যান। ট্রাম্পের নাম না নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন একটা ক্ষমতাকে দেখেছি, যারা আমাদের জাতিটাকে সবার মধ্যে ভাগ না করে বরং ভেঙেচুরে সর্বনাশ করেছে। তারা গণতন্ত্রকে বিলম্বিত করে এই দেশটাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। তাদের এ অপচেষ্টা প্রায় সফলও হচ্ছিল। তবে গণতন্ত্র বিলম্বিত হতে পারে, কিন্তু কখনই চিরতরে পরাজিত হয় না।
বাইডেন-কমলার শপথের দিনকে ‘গণতন্ত্রের জন্য বড়দিন’ বলে মন্তব্য করেছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ্পি কন্তে। ইউরোপীয় পিপল’স পার্টির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক বলেছেন, ‘এখন আমরা মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারব। শুভকামনা জো ও কমলা।’
শপথ অনুষ্ঠানে বাইডেনের স্ত্রী ফার্স্ট লেডি ড. জিল বাইডেন এবং কমলার স্বামী ডগ এমহফ ছিলেন। ৩ নভেম্বর নির্বাচন হয়েছিল। দেশটির ইতিহাসে এবার সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ভোট পড়েছিল। ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে বাইডেন পেয়েছেন ৩০৬ এবং ট্রাম্প ২৩২ ভোট; জয়ের সূচক ছিল ২৭০টি। এছাড়া ট্রাম্পের চেয়ে অন্তত ৭০ লাখ জনপ্রিয় ভোট বেশি পেয়েছেন বাইডেন।
প্রথম থেকেই কিছুতেই পরাজয় স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না ট্রাম্প, উল্টো বারবারই বলছিলেন- ভোটে জালিয়াতি হয়েছে, আদালতে গিয়ে সব ফল উল্টে দেবেন তিনি। কিন্তু তার ভিত্তিহীন অভিযোগ অপ্রমাণিত বলে আদালতও তার পক্ষে রায় দেননি। শেষে, উপায়ান্তরহীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘স্ব-অভ্যুত্থান’-এর পথ বেছে নেন। তার কথায়, বলা ভালো তার নির্দেশে, ৬ জানুয়ারি মার্কিন সংসদ ভবনে ভাঙচুর চালায় তার উগ্র সমর্থকরা। সেই দাঙ্গার জেরে অন্তত পাঁচজনের প্রাণ যায়।
এমন নজিরবিহীন নৈরাজ্যের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সতর্কতা জারি করা হয়। ট্রাম্পের সমর্থকরা বাইডেনের শপথের দিন দেশটির ৫০ রাজ্যেই এরকম হামলার পরিকল্পনা করছে বলে আশঙ্কা করা হয়। এরকম বাস্তবতায় ক্যাপিটলকে ঘিরে ফেলা হয় শক্তিশালী বহুস্তরী নিরাপত্তা মোড়কে।
Leave a Reply