‘আমরা এ মাটির সন্তান। আমরা সব কথা কোর্টে বলতে পারি না। এখানে সাংবাদিকরাও থাকেন। ফাঁসি হবে জেনেও আসামিরা কি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? জবানবন্দিতে আসামিরা মেয়েটিকে হত্যা করার কথা তা হলে কি শখ করে বলেছে?’- নারায়ণগঞ্জে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করার কথা স্বীকার করে আদালতে আসামিদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার পর সেই ছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার বিস্ময়কর কাণ্ডের মামলায় শুনানিকালে গতকাল হাইকোর্ট এমন কথা বলেন। এর পর মন্তব্য করেন, ‘এটা দুর্ভাগ্যজনক। অভাগা তো হলো এ দেশের জনগণ।’
‘মৃত’ ওই কিশোরীর ফিরে আসার ঘটনায় বিচারিক অনুসন্ধান কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের ওপর শুনানির একপর্যায়ে গতকাল বুধবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। শুনানিকালে হাইকোর্ট আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জের এই একটি ঘটনাকে পুলিশের পুরো বাহিনীর গায়ে মাখানোর দরকার নেই। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবেই তাদের দেখা উচিত। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, তা হলে তা থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়, সেটা পুলিশ বাহিনীর ভেবে দেখা উচিত। আদালত আরও বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পুলিশ হেফাজতে থাকাবস্থায় যদি কোনো ব্যক্তিকে একটা কটু কথাও বলা হয়, সেটা অপরাধ হিসেবে দেখা হয়।
গত বছরের ২৪ আগস্ট ‘ধর্ষণের পর নদীতে মরদেহ ফেলে দেওয়া স্কুলছাত্রীর ৪৯ দিন পর জীবিত প্রত্যাবর্তনের’ খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ঘটনার বিবরণী থেকে জানা যায়, গত বছরের ৪ জুলাই পঞ্চম শ্রেণির ওই ছাত্রী নিখোঁজ হয়। ৬ আগস্ট ওর বাবা নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা করেন। মামলার পর পুলিশ আবদুল্লাহ, রকিব ও খলিল নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। স্বীকারোক্তিতে তারা বলেন, ওই ছাত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে মরদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। জবানবন্দি নেওয়ার পর আসামিদের জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু ২৩ আগস্ট ওই ছাত্রীকে খুঁজে পাওয়া যায়। এ অবস্থায় ছাত্রীর বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় করা মামলা এবং মামলা পরবর্তী প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা, বৈধতা, যৌক্তিকতা ও মামলার নথি তলব চেয়ে গত বছরের ২৫ আগস্ট পাঁচ আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিভিশন আবেদন করেন।
পরে ২৭ আগস্ট ওই রিভিশন আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে ছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় সাবেক তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেন হাইকোর্ট। মামলার নথিসহ হাজির হতে নির্দেশ দেন বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তাকে। সেই অনুসারে তারা হাজির হয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর ব্যাখ্যা দেন। এর পর আদালত গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য দিন রাখেন। পরে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিচারিক অনুসন্ধানে নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সে অনুযায়ী বিচারিক অনুসন্ধানের প্রতিবেদন গত ৫ জানুয়ারি আদালতে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনের মতামত অংশে বলা হয়, ‘…তবে পুলিশ হেফাজতে (পুলিশ রিমান্ডে) থাকাকালীন সময়ে তদন্ত কর্মকর্তা মো. শামীম আল-মামুন, এসআই নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা এর বিরুদ্ধে আসামিদের মারধর, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে স্বীকারোক্তি প্রদানে বাধ্য করার অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়।’
এ প্রতিবেদনের ওপরই গতকাল হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি হয়। শুনানিতে পুলিশের পক্ষে অংশ নেন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী, রিভিশন আবেদনের পক্ষে অ্যাডভোকেট শিশির মোহাম্মদ মনির এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পী।
শুনানিতে তদন্ত কর্মকর্তার পক্ষে আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, বিচারিক তদন্ত কমিটির রিপোর্টে পুলিশ বাহিনীর ওপর একটা দোষ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অতিরঞ্জিত কিছু করেননি। তিনি তার আওতার মধ্যে থেকেই আসামি গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়েছেন। আসামিদের কোনো নির্যাতন করা হয়নি। কারণ আসামিরা জুডিশিয়াল কমিটির বাইরে আর কারও কাছে নির্যাতনের কথা তুলে ধরেননি।
আদালত বলেন, তা হলে আমরা কি ধরে নেব জবানবন্দিতে আসামিরা যে বক্তব্য দিয়েছে সেটা সত্য নয়? ভিকটিমকে মেরে নদীতে ফেলার যে জবানবন্দি তাতে আসামিদের স্বার্থ কী? বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘দেশের মানুষ ক্ষুদিরামের ফাঁসি দেখতে চেয়েছিল। এই জন্য কি সকলেই ফাঁসিতে যেতে চায়! এ বিষয়ে আমাদের একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে।’
মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ভিকটিম বিচারিক কমিটির কাছে বলেছে, আসামি আবদুল্লাহ তাকে ধর্ষণ করেছে। আদালত বলেন, ২২ ধারার জবানবন্দিতে মেয়েটি আদালতে কী বলেছে? দুটো জবানবন্দির মধ্যে কোনটি আমরা সঠিক মনে করব?
শুনানিকালে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সরোয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, আসামিরা রিমান্ডের পর দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ সময় তারা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নির্যাতনের কথা বলে নাই। আদালত বলেন, আপনাদের দুজনের শুনানি গ্রহণ করলে আসামিদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য বলে ধরে নিতে হয়।
মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা ভিকটিমকে উদ্ধার করেছে সে জন্য জুডিসিয়াল রিপোর্টে তার প্রশংসাও করা হয়েছে। এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক হবে না। তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আল মামুনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিনকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, ভারতে কোনো আসামিকে রিমান্ডে নেওয়া হলে সেখানে আইনজীবী রাখার সুযোগ আছে। সে জন্য তারা সিআরপিসি সংশোধনও করেছে। আমরা তো কোর্ট থেকে আইন সংশোধনের কথা বললে নানা প্রতিক্রিয়া হয়।
বাংলাদেশ বনাম ব্লাস্ট মামলার উদাহরণ তুলে ধরে মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, এ মামলায় বলে দিয়েছে রিমান্ডে আইনজীবী রাখার সুযোগ আছে। তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ মামলাটির রিভিউ এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। আপনারা (হাইকোর্ট) পর্যবেক্ষণ দিতে পারেন। আদালত বলেন, হাইকোর্টের কাজ কি তা হলে রুল মঞ্জুর বা খারিজ করা আর জামিন দেওয়া?
এ পর্যায়ে রিভিশন মামলার আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ব্লাস্ট বনাম রাষ্ট্র মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যে রিভিউ চাওয়া হয়েছে সেখানে রিমান্ডে আইনজীবী রাখার বিষয়ে কোনো বিরোধিতা করা হয়নি। এর পরই হাইকোর্ট নারায়ণগঞ্জের মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী বুধবার দিন ধার্য করেন। ওইদিন অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনবেন আদালত।
Leave a Reply