দেশে প্রায় সব ভোগ্যপণ্যেই ভেজাল- সাধারণ মানুষের ধারণা এমনই। বিভিন্ন গবেষণাতেও এ ধারণার সত্যতা প্রমাণিত। শিশুখাদ্য, প্রসাধন সামগ্রী, এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল। প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে এসব তথ্য নিতান্তই অপপ্রচার মনে হবে ‘আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের’ খাদ্য পরীক্ষার পরিসংখ্যান দেখলে। সংস্থাটি ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০৯টি খাদ্য নমুনা পরীক্ষা করে ভেজাল পেয়েছে মাত্র ১৮টিতে। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে খোদ সংস্থাটির দেখভালের দায়িত্বে থাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মকর্তাদের মধ্যেই।
দৈনিক আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খাদ্যের নমুনা সংগ্রহের পর টাকার বিনিময়ে ‘খাঁটি’ বলে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। আবার অনেক নমুনার পরীক্ষাই করা হয় না। টাকার বিনিময়ে পরীক্ষা ছাড়াই সনদ সংগ্রহ করা হয়। টাকা না দিলে পণ্য ভেজাল হিসেবে সনদ পায়।
রাজধানীর ব্যস্ততম বঙ্গবাজার মোড়ে, ফনিক্স রোডের উল্টোপাশে পাঁচতলা ভবনে অবস্থিত আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘আরবান পাবলিক অ্যান্ড এনভায়রমেন্ট হেলথ সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের’ আওতায় বাস্তবায়ন করা হয়। বর্তমানে এটির দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে ডিএসসিসি।
গত বছরের ২ জুলাই ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস কেন্দ্রটির আধুনিকায়ন শেষে উদ্বোধন করেন। সেই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পরীক্ষাগার। ফলে এখন থেকে আমরা সব ধরনের পণ্যের মান সঠিকভাবে নিরূপণ এবং ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারব। তাই ঢাকাবাসীর জনস্বাস্থ্য তথা স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করতে এ আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগারটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি আরও বলেন, খাদ্যসামগ্রীর মান নিশ্চিতের জন্য সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও মান নির্ণয়ে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ছিল না। এই পরীক্ষাগার উদ্বোধনের মাধ্যমে আমরা মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলাম।
সূত্র জানায়, পরীক্ষাগারের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যুক্ত করা হয়েছে ল্যাবটিতে। জার্মানি, জাপান ও বেলজিয়াম থেকে আনা হয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। ল্যাবের ফার্নিচারগুলো আনা হয়েছে পর্তুগাল থেকে। মূলত এই ল্যাবটিতে প্যাকেট ও বোতলজাত খাবার পরীক্ষা করা হয়। এখানে তেল, পানি, দুধ, বিস্কুট, মিল্ক পাউডার ও ক্রিম পাউডার, আইসক্রিম, সুজি, ময়দা, কেক, ফ্রুট ড্রিংক, সেমাই, রুটি, মিনারেল ওয়াটারসহ ৪৯টি খাদ্যপণ্যের বিভিন্ন মান পরীক্ষা করার ক্ষমতা রয়েছে।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর শনিরআখড়া এলাকার গৌরনদী মিষ্টান্নভা-ার থেকে পরীক্ষার জন্য মিষ্টি আনেন একজন ফুড ইন্সপেক্টর। ২৪ নভেম্বর আধুনিক পরীক্ষাগার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জনস্বাস্থ্য অ্যানালিস্ট ড. মো. মোহসীন আলীর ভাই পরিচয়ে ওই মিষ্টান্নভা-ারে যান এক ব্যক্তি। টাকা দিলে পণ্যের মান পজিটিভ করে দেবেন বলে আশ্বাস
দেন তিনি। মিষ্টান্নভা-ারের মালিকের সঙ্গে তার আলাপচারিতার একটি সিসিটিভি ফুটেজ আমাদের সময়ের হাতে রয়েছে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই ফুড ল্যাবটির প্রধান জনস্বাস্থ্য অ্যানালিস্ট ড. মো. মোহসীন আলীর সঙ্গে দেখা যায় ওই ব্যক্তিকে। হাসিমুখে তারা গল্প করছেন। এরও ভিডিও ফুটেজ আমাদের সময়ের হাতে রয়েছে।
এ বিষয়ে গৌরনদী মিষ্টান্নভা-ারের মালিক পংকজ মিত্র আমাদের সময়কে বলেন, আমার প্রতিষ্ঠান থেকে মিষ্টি পরীক্ষার জন্য একজন ফুড ইন্সপেক্টর এক কেজি মিষ্টি নেন। পরে এক ব্যক্তি এসে বলেন, আপনার প্রতিষ্ঠানের মিষ্টি খারাপ। পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসবে। প্রায় তিন লাখ টাকার মামলা। আপনি চাইলে আরও কিছু কম টাকায় রিপোর্ট পজিটিভ বানিয়ে দেওয়া যাবে। তিনি আরও জানান, বিষয়টি নিয়ে কদমতলী থানায় জিডি করা হয়েছে।
সম্প্রতি নিজেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে ফুড ল্যাবটিতে যান এই প্রতিবেদক। প্রবেশের ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের নিষেধাজ্ঞা থাকার দোহাই দিয়ে প্রবেশ করতে বাধা দেন সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। তবে নিজেকে টমেটো সস ব্যবসায়ী এবং ফুড ইন্সপেক্টর পরীক্ষা করার জন্য সসের নমুনা এনেছেন- এমনটি বললে সুর নরম হয় সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকাদের। পরীক্ষার ফল যেন পজিটিভ আসে- এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য অ্যানালিস্টের সঙ্গে দেখা করার কথা বললে ওই নিরাপত্তাকর্মী ভেতর থেকে অনুমতি আনতে যান। কিছুক্ষণ পর অনুমতি এলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। গেটেই দেখা এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি সমস্যা শুনতে চাইলেন। সব শুনে বললেন, এটি কোনো বিষয় নয়, অ্যানালিস্টের সঙ্গে কথা বলে তিনিই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবেন। আকার-ইঙ্গিতে বোঝান- খরচ খুব বেশি হবে না। পরবর্তীতে তিনি রাতে বাইরে কোথাও কথা বলে বিষয়টি ফাইনাল করা হবে বলেও আশ্বস্ত করেন। তার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় নিরাপত্তাকর্মীরাও আশ্বস্ত করলেন এটি কোনো বিষয় নয়। টাকা খরচ করলেই রেজাল্ট পক্ষে থাকবে। ক্ষেত্র বিশেষ পরীক্ষাও হয় না।
অন্তত ১০জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সবাই এমন অভিজ্ঞতার কথাই জানান। তারা বলেন, ইন্সপেক্টররা অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসেই ‘সমাধান’ করে পণ্য আর পরীক্ষাগারেই নেন না। ক্ষেত্রবিশেষে পরীক্ষাগারে নিলেও আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে পণ্য পরীক্ষা করা হয় না। পরীক্ষা হলেও সনদ দেওয়া হয় ‘খাঁটি’ বলে।
অভিযোগ রয়েছে পরীক্ষাগারে টাকার বিনিময়ে ‘খাঁটি’ সনদ দেওয়ার জন্য একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ফুড ইন্সপেক্টররা খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে ফুড ল্যাবে জমা দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সিন্ডিকেটের নিয়োজিতরা। পরে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে খাদ্যের ‘মান নির্ধারণ’ করা হয়।
গত এক বছরে মাত্র ২০৯টি পণ্যর নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এরমধ্যে ১৮৪টি মানসম্পন্ন ও ১৮টি মানসম্পন্ন নয় বলে প্রতীয়মান হয়। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৩১টি নমুনা পরীক্ষায় ২৭টি মানসম্পন্ন ও ৪টি মানহীন। ফেব্রুয়ারিতে ১৬টি নমুনা পরীক্ষায় ১৪টি মানসম্পন্ন ও ২টি মানহীন। মার্চে ১টি পণ্য পরীক্ষা হয়, সেটি মানসম্পন্ন বলে বিবেচিত হয়। মে, জুন ও জুলাইয়ে পরীক্ষা বন্ধ ছিল। আগস্টে ৩৪টি নমুনার মধ্যে ৩২টি মানসম্পন্ন ও ২টি মানহীন; সেপ্টেম্বরে ৩১টি নমুনার সবই মানসম্পন্ন; অক্টোবরে ৩৯টি নমুনার ৩৭টি মানসম্পন্ন ও ২টি মানহীন; নভেম্বরে ৩০টি নমুনার ২৫টি মানসম্পন্ন ও ৫টি মানহীন; ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ পর্যন্ত ২০টি নমুনার ১৭টি মানসম্পন্ন ও ৩টি মানহীন বলে সনদ পায়।
অথচ ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ল্যাবটির নমুনা পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই সময়ে সর্বনিম্ন ২৯ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ ভাগ পর্যন্ত নমুনা ভেজাল বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু ২০২০ সালে ২০৯ নমুনায় ভেজাল মাত্র ১৮টি। শতকরা হিসেবে এর হার মাত্র মাত্র ৯। পরীক্ষা করা হয়নি ৭টি নমুনা।
সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, সাধারণত ভেজাল সন্দেহেই খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করেন ফুড ইন্সপেক্টররা। সেক্ষেত্রে ৪০/৫০ ভাগ নমুনাই পরীক্ষাগারে ভেজাল হিসেবে প্রমাণিত হয়। তবে সংগৃহীত নমুনার মাত্র ৯ ভাগ ভেজাল হওয়াটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, তথ্যপ্রমাণ পেলে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জনস্বাস্থ্য অ্যানালিস্ট ড. মো. মোহসীন আলী বলেন, এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে একটি সিন্ডিকেট চাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি ভালোভাবে পরিচালিত না হোক। এজন্য তারা নানা ধরনের মিথ্যা প্রপাগন্ডা ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, কিছু দুর্নীতিবাজ ফুড ইন্সপেক্টর তুলনামূলক ভালো খাদ্যগুলো নমুনা হিসেবে আনেন। ঘুরেফিরে একই ধরনের নমুনা আনেন। এক্ষেত্রে বেশিরভাগই খাঁটি হিসেবে প্রমাণিত হয়।
Leave a Reply