দেশের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণে ও নিরাপদ রাখতে স্থাপন করা হচ্ছে অত্যাধুনিক রাডার। বিদ্যমান দুর্বল রাডার ব্যবস্থাপনায় গণ্ডির বাইরে থাকা আকাশপথে কোনো উড়োজাহাজ গেলে সেটার তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে না। অত্যাধুনিক রাডার সিস্টেম স্থাপনের পর দেশের আকাশসীমা দিয়ে যত উড়োজাহাজ যাবে তার সবই জানা যাবে। এজন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্থাপন করা হবে সিএনএস-এটিএম (রাডারসহ) সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি।
ফ্রান্স থেকে রাডার ও আনুষঙ্গিক এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ নেভিগেশন ও নজরদারি সংক্রান্ত সিস্টেমের সরবরাহকরণ, সংস্থাপন এবং কার্যকরের ফলে নতুন সমুদ্রসীমাসহ দেশের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। নিরাপদ হবে আকাশপথ। ওভারফ্লাইং চার্জের মাধ্যমে বাড়বে রাজস্ব।
জিটুজি (সরকার-সরকার) পদ্ধতিতে রাডারসহ অন্তত ২০ ধরনের উপকরণ সংগ্রহ করবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। ফ্রান্সের থ্যালেস টেকনোলজির আর্থিক প্রস্তাব নিয়ে নেগোসিয়েশন চলে। এরপর তা চূড়ান্ত করা হয় গত ৪ জানুয়ারি। সেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এখন এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হচ্ছে। সব ঠিক থাকলে ফেব্রুয়ারিতে চুক্তি হওয়ার কথা। চুক্তির পর তা সরবরাহ করতে সময় লাগবে ৩৩ মাস। বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান
আমাদের সময়কে বলেন, পুরনো রাডারের কার্যক্ষমতা কম। সেটি দিয়ে এয়ার ট্রাফিকসহ আকাশপথে নজরদারি চালাতে প্রায়ই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। সক্ষমতা কম হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকা কাভার করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব এলাকায় রাডার কাভারেজের মাধ্যমে এয়ার ট্রাফিকিং করে আয় করছে প্রতিবেশী দেশ। নিজেদের সক্ষমতা না থাকলে আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) বিধি অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশ তা পারে। এ প্রেক্ষাপটে সক্ষমতা বাড়াতে থ্যালেস থেকে যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে বেবিচকের নিজস্ব অর্থায়নে।
বেবিচকের সদস্য (ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশনস) গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী মো. জিয়াউল কবীর বলেন, ক্রয় প্রক্রিয়াধীন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির স্পেসিফিকেশন এরই মধ্যে আইকাওর অনুমোদন পেয়েছে। এখন চুক্তির আগে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখান থেকে যাবে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে।
বর্তমানে পুরনো রাডার ও ত্রুটিপূর্ণ রেডিও ব্যবস্থা দিয়েই চলছে দেশের এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (এটিএম)। ৩৮ বছরের পুরনো এই রাডারে প্রায় সময় ধরা পড়ে না উড়ে যাওয়া বিমান। তা ছাড়া প্রায় সময় পাইলটের সঙ্গে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের (এটিসি) যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কখনো কখনো কথোপকথনে পরিষ্কার শুনতে সমস্যার সমুখীন হচ্ছেন পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা। এমন এয়ার ট্রাফিক সিস্টেম দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন নিরাপদ এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট করতে গিয়ে মানসিক চাপে থাকেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ২০ অক্টোবর রাডার ক্রয় চুক্তির বিষয়ে বেবিচক ও ফ্রান্স দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। আলোচনায় রাডার ও আনুষঙ্গিক এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ নেভিগেশন ও নজরদারি সংক্রান্ত সিস্টেমের সরবরাহকরণ, সংস্থাপন এবং কার্যকরের বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়। রাডারের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত কঠোরভাবে গোপন রাখবে দুই দেশ, যাতে আকাশসীমার নিরাপত্তার বিষয়টি তৃতীয় কোনো দেশের কাছে যেতে না পারে।
বর্তমানে ঢাকায় শাহজালাল বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের উত্তর পাশেই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার। এই টাওয়ার থেকেই সার্বক্ষণিক উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের পাইলটদের চলাচলে নির্দেশনা দেন ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা। বাংলাদেশের আকাশসীমায় উড়োজাহাজের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ, আবহাওয়ার তথ্য প্রদান, শাহজালাল বিমানবন্দরে উড্ডয়ন-অবতরণের অনুমতি, বিমানবন্দরের গ্রাউন্ডে চলাচল, পার্কিং- এ বিষয়গুলোর ভিত্তিতে পৃথক রেডিও চ্যানেলের মাধ্যমে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা পাইলটদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। তবে এই টাওয়ারটি টার্মিনাল ভবন থেকে বেশি উচ্চতার না হওয়ায় পুরো বিমানবন্দর নজরদারিতে বিপত্তিতে পড়ছেন কন্ট্রোলাররা। তা ছাড়া রেডিও ট্রান্সমিশনেও সমস্যা হয়, মাঝে মাঝে জ্যামিং হয়ে যায়। এসব বিবেচনায় ২০০৫ সালে বিমানবন্দরে নতুন রাডার প্রতিস্থাপনে উদ্যোগ নেয় বেবিচক।
পিপিপির আওতায় রাডার স্থাপনের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২০১৫ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু অস্বাভাবিক দর দেখানোর কারণে দরপত্র বাতিল করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এরপর ২০১৭ সালের ১ মার্চ পিপিপির পরিবর্তে সরকারি অর্থায়নে সাপ্লাই ইনস্টলেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন অব মাল্টি মোড সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম (রাডার, এডিএস-বি) এটিএস অ্যান্ড কমিউনিকেশন সিস্টেম শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। এ প্রকল্পেরই নতুন নামকরণ করা হয়েছে সিএনএস-এটিএম প্রকল্প। এখন এ খাতে ৭০০ কোটি টাকার কিছু বেশি খরচ পড়ছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে থাকছে সার্ভিল্যান্স, অটোমেশন ও ভয়েস কমিউনিকেশন সিস্টেম। এসব কম্পোনেন্টের সমন্বয়ে গড়া এই সিস্টেম বাস্তবায়ন করা হলে দেশের আকাশপথ হবে বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ বিমান চলাচলের রুট।
গত বছরের ২০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিমান চলাচল সম্পর্কিত কারিগরি সহায়তা ও তথ্য আদান-প্রদানে ফ্রান্সের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব সিভিল এভিয়েশন ও বেবিচকের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, রাডার আধুনিকায়নে বিভিন্ন স্ট্যান্ডার্ডস ও রিকমেন্ডেড প্র্যাকটিস বাস্তবায়নে একসঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স। বেসামরিক বিমানের সুরক্ষিত উড্ডয়নের বিষয়গুলোও তারা দেখবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাবেন প্রশিক্ষণ। বেসামরিক বিমানের উড্ডয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ আরও উন্নত হবে।
Leave a Reply