পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দুর্নীতিবাজ, দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গকারী, অনুপ্রবেশকারী, স্বাধীনতাবিরোধী পরিবার ও তাদের আত্মীয়স্বজনসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত রয়েছে- এমন প্রার্থীদের কোনোভাবেই এবার মনোনয়ন দেবে না দলটি।
কুমিল্লার দাউদকান্দি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছেন বর্তমান মেয়র নাইম ইউসুফ সেইন। তিনি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ পদে রয়েছেন। গত পৌরসভার নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের অভিযোগ, নাইম ইউসুফ সেইন সরকারের তালিকাভুক্ত রাজাকার মরহুম আবদুস সামাদের দৌহিত্র। আবদুস সামাদ পৌরসভার হাসানপুর গ্রামের বাসিন্দা। রাজাকারের তালিকার ৪৮ নম্বর পাতার ৫০৯ নম্বরে তার নাম উল্লেখ রয়েছে, যা নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। এ ছাড়াও নৌকা মার্কা প্রতীক নিয়ে পৌরমেয়র নির্বাচিত হলেও গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নাইম ইউসুফের ভোটকেন্দ্রে নৌকার ভরাডুবি হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়েও স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। তার সম্পর্কে অভিযোগের বিষয়টি ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ থাকায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই মেয়র পদে তাকে মনোনয়ন না দেয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে পৌরসভার মেয়র নাইম ইউসুফের ব্যক্তিগত মোবাইলে গতকাল একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
গত ২৮ নভেম্বর আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে প্রথম ধাপের ২৫টি পৌরসভায় নির্বাচনে মেয়র পদে ২৫ জনকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়। এরপর তিন দিনের মধ্যে তিনজনকে পরিবর্তন করে নতুন তিন প্রার্থী ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারদের কাছে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ। কুষ্টিয়ার খোকসা পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে আল মাছুম মুর্শেদ শান্তকে বাদ দিয়ে তারিকুল ইসলাম তারিককে, চুয়াডাঙ্গা পৌরসভায় রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দারকে বাদ দিয়ে জাহাঙ্গীর আলম মালিককে এবং নেত্রকোনার মদন পৌরসভায় মো: আবদুল হান্নান তালুকদারকে বাদ দিয়ে সাইফুল ইসলাম সাইফকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত পৌরসভা নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আল মাছুম মুর্শেদ শান্ত। এ জন্য মনোনয়ন থেকে শেষমেশ ছিটকে পড়েন তিনি। চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা নির্বাচনে প্রথমে মনোনয়ন পান স্থানীয় এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দারের ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার। গত পৌর নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে বিদ্রোহী প্রার্থী ওবায়দুর রহমান চৌধুরীর কাছে হেরে গিয়ে তিনি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন চান। কিন্তু মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি পরাজিত হন। এ জন্য তাকেও শেষমেশ বাদ দেয়া হয়েছে। নেত্রকোনার মদন পৌরসভায় প্রথমে মনোনয়ন পান বর্তমান মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো: আবদুল হান্নান তালুকদার। গত নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে তিনি জয়লাভ করেন। প্রাথমিকভাবে তাকে মনোনয়ন দিলেও তৃণমূলের অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি বাদ পড়েন।
এ রকম দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারী ও শৃঙ্খলাভঙ্গকারী, দুর্নীতিবাজ, স্বাধীনতাবিরোধী পরিবার ও তাদের আত্মীয়স্বজনসহ নানা বিতর্কিত লোকজন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারি দলের মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। তবে যারা নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আছে, তাদের কোনোভাবেই দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে না বলে দলটির নীতিনির্ধারকেরা জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, জনপ্রিয়, স্বচ্ছ ও ক্লিন ইমেজধারী প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া হবে। তিনি বলেন, যারা স্বাধীনতাবিরোধী ও নানাভাবে বিতর্কিত এমন কোনো প্রার্থী মনোনয়ন পাবে না।
মনোনয়ন দেয়া প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, পৌরসভা নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। মনোনয়ন চূড়ান্ত করার জন্য দলীয় সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড রয়েছে। ওই মনোনয়ন বোর্ডকে বিতর্কিত, কে স্বাধীনতাবিরোধী, কে জনপ্রিয় এসব নানা বিষয় যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবে।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, প্রথম ধাপে ২৫টি পৌরসভার মধ্যে ২৪টির ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ২৮ ডিসেম্বর। ১৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপে হবে ৬১ পৌরসভায়, তৃতীয় ধাপে ৩০ জানুয়ারি ৬৪টি পৌরসভায় এবং চতুর্থ ধাপে ৫৬ পৌরসভায় ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোট অনুষ্ঠিত হবে। ৫ জানুয়ারি থেকে চতুর্থ ধাপের নির্বাচনের জন্য মেয়র পদে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমাদানের কার্যক্রম চলছে।
Leave a Reply