‘আমি দেয়াল ভাঙবই। ক্ষমতা থাকলে বাধা দেবেন।’ এভাবেই প্রচণ্ড দাম্ভিকতার সঙ্গে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে অবস্থিত ইউনিক সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানার সীমানা প্রাচীর ভাঙার হুমকি দিয়েছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাসির উদ্দিন মোল্লা। এর পর গত বুধবার হামলা চালানো হয়। তাদের তাণ্ডবে কাউন্সিলরের নেতৃত্বে কারখানাটি দীর্ঘ ১৫০ ফুট সীমানা প্রাচীর ও সংলগ্ন মার্কেটের সিঁড়ি ভাঙচুর করা হয়।
এ সময় শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে কারখানার নিরাপত্তারক্ষীদের। এখানেই থেমে যায়নি নাসির মোল্লা। চোরের মায়ের বড় গলার মত কর্মচারীদের হুমকি ধামকি দেওয়া হচ্ছে। একদিকে কারখানার সীমানাপ্রাচীর ভাঙা হলেও অন্য দিকে বাড়ি ভাঙা হবে না বলে অনেকের কাছ থেকে চাঁদাবাজী করছেন দাপুটে এই কাউন্সিলর। এ অবস্থায় অসহায় হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা।
কারখানার সীমানা প্রাচীর ভাঙচুর ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগে গতকাল শুক্রবার দুপুরে কাউন্সিলর নাসিরের বিরুদ্ধে কোনাবাড়ী থানায় একটি অভিযোগ করা হয়েছে। ইউনিক সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের পক্ষে সিনিয়র সিকিউরিটি সুপারভাইজার হান্নান বিশ্বাস এ অভিযোগ দায়ের করেন। কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু সিদ্দিক অভিযোগ দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ইউনিক সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপক মো. শফিকুল ইসলাম ও নিরাপত্তা সুপারভাইজার একেএম রওশন আলম জানান, গত বুধবার বিকালে স্থানীয় কাউন্সিলরের নেতৃত্বে একদল যুবক একটি এক্সকেভেটর (ভেকু) দিয়ে কারখানার সীমানা প্রাচীর ভাঙতে আসে। এ সময় বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা দুর্ব্যবহার করে। একপর্যায়ে কাউন্সিলরের নেতৃত্বে দুর্বৃত্তরা নিরাপত্তারক্ষী ও কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধাওয়া দেয়। কয়েকজনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এ পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার্থে অন্যরা দৌড়ে কারখানার মূল ফটকের ভেতরে আশ্রয় নেন।
ইউনিক সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সিকিউরিটি সুপারভাইজার হান্নান বিশ্বাস বলেন, কারখানার সিসিটিভি ফুটেজে ভাঙচুর, ধাওয়া ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার দৃশ্য সংরক্ষিত রয়েছে। কারখানার সীমানা প্রাচীর ভাঙচুরের কারণে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে আইনের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
এক বছর আগে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রিফিউজি পাড়া সড়কে ৫৭৩ মিটার আরসিসি ড্রেন নির্মাণের কাজ পায় এআরকে লিমিটেড। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী মো. তৌহিদ জানান, মহল্লার ভেতরে রাস্তা মাত্র ৮ ফুট প্রশস্ত। খোদ কাউন্সিলরের বাড়িও এই ৮ ফুট রাস্তার পাশে। তিনিসহ আশপাশের কোনো বাড়ির মালিকই রাস্তার জন্য জমি ছাড়েননি। এ কারণে ড্রেনও নির্মাণ করা যাচ্ছে না। এদিকে কাজের সময়সীমাও পেরিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত সড়কের শেষ প্রান্তে ৮ ফুট রাস্তার মাঝ বরাবর ৬ ফুট প্রশস্ত ১০০ মিটারের কাজ হয়েছে।
সড়কের শেষ প্রান্তে রাস্তার মাঝ বরাবর ড্রেন নির্মাণ শুরু করা হয়েছে। অথচ একই ড্রেন সড়কের প্রবেশমুখে রাস্তার পাশে নির্মাণের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এমন দ্বিমূখী আচরণের কারণ জানতে চাইলে প্রকৌশলী তৌহিদ জানান, কাউন্সিলর এভাবে চাচ্ছেন। ঠিকাদার শুধু বিষয়টি কার্যকর করবেন।
কারখানার ব্যবস্থাপক মো. শফিকুল জানান, ড্রেন নির্মাণ নিয়ে এ অবস্থার মধ্যেই সিটি কর্তৃপক্ষ সড়ক প্রশস্তকরণে নতুন প্রকল্প নিয়েছে। সড়ক প্রশস্তকরণের ব্যাপারে কাউন্সিলর ও কারখানার মালিকপক্ষের একাধিক বৈঠক হয়েছে। ইউনিক সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষ রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি ছাড় দিতে সম্মতি জানিয়েছে। এ অবস্থায় কোনো ধরনের নোটিশ না দিয়েই কারখানার সীমানা প্রাচীর ভাঙচুর করা হয়।
সড়ক প্রশস্তকরণ বন্ধে কাউন্সিলরের চাঁদাবাজি
একদিকে সড়ক প্রশস্তকরণের নামে অবৈধভাবে সীমানা প্রাচীর ভাঙচুর করা হচ্ছে। অন্যদিকে একই সড়ক প্রশস্তকরণ বন্ধে এলাকাবাসীর কাছ থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে খোদ কাউন্সিলর নাসির উদ্দিন মোল্লার বিরুদ্ধে। এলাকার বাসিন্দা সমির উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, ‘কাউন্সিলর বললেন, তোমাদের ছোট ছোট বাড়ি। যদি কিছু টাকা দাও তা হলে তোমাদের বাড়িঘর যেন ভাঙা না পড়ে সেই চেষ্টা করব। তার কথায় আমি ২৫ হাজার টাকা দিয়েছি। এলাকার প্রায় সবাই কেউ ২৫ হাজার, ৫০ হাজার, কেউ এক লাখ টাকাও দিয়েছে।’
সমির উদ্দিন বলেন, সড়কের পাশে তার ৩৩ ফুট প্রশস্ত একটি তিন তলা ভবনের সামনে ১০ থেকে ১১ ফুট সড়কের জন্য ছাড়তে হবে। কিন্তু তা না ছাড়তে এবং বাড়ি যেন ভাঙা না পড়ে এ জন্য কাউন্সিলর নাসির উদ্দিনকে ২৫ হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছেন। পরে আরও ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথাও রয়েছে। আমাদের সময়ের কাছে সমির উদ্দিনের বক্তব্যের ভিডিও সংরক্ষিত রয়েছে।
এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, মৃত রফিকুল ইসলামের স্ত্রী রহিমনের কাছ থেকে এক লাখ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া আবদুর রশিদ, সানোয়ার, ইদ্রিস, আরব আলী নামের কয়েকজন বাসিন্দাও চাঁদা দিয়েছেন। রাস্তা প্রশস্তকরণ বন্ধের নামে সড়কের দুপাশের বাড়ি মালিকদের কাছ থেকে কাউন্সিলর ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিয়েছেন।
চাঁদা তোলার ব্যাপারে ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মিজানুর রহমান বলেন, সমাজকল্যাণের দেয়াল সরিয়ে পুনর্নির্মাণ বাবদ এ টাকা তোলা হয়েছে। তবে সেই কাজও হয়নি। টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে বলেও আমার জানা নেই।
এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে কাউন্সিলর নাসির উদ্দিন মোল্লা কোনো ধরনের চাঁদা তোলার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সীমানা প্রাচীর ভেঙেছে। আমার নিজের বাড়িও ভাঙা পড়বে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন কোনাবাড়ী জোনের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. তারিক হাসান আমাদের সময়কে বলেন, এলাকায় কাউন্সিলর কী করছেন তা আমাদের জানা নেই। তবে সড়ক প্রশস্তকরণের জন্য সড়কের দুই পাশ থেকেই জমি নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় কাউন্সিলরের নেতৃত্বে এলাকাবাসী ও জমির মালিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ সংক্রান্ত সব সমস্যা সমাধান করা হয়।
Leave a Reply