রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছে বাংলাদেশে অন্যতম বিরোধীদল বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোমবার (১৪ ডিসেম্বর) ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন করে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের সরকারি পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেছেন।
রোহিঙ্গা সংকটের শুরুর দিকে বিএনপি নানা বক্তব্য দিলেও পরে লম্বা সময় ধরে নীরব থেকেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পর আবার এ নিয়ে বিএনপি মুখ খুলেছে। দলটির মহাসচিব বলেছেন, সরকারের এমন পদক্ষেপের কারণে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে নতুন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বিএনপির অভিযোগকে কল্পনাপ্রসূত বলে বর্ণনা করেছেন।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের সরকারি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। দলটি মনে করছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর চেষ্টায় সরকার কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে ব্যর্থ হয়ে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে।
বিএনপির নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আলোচনার ভিত্তিতে সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে তারা তাদের দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের পদক্ষেপ নতুন সংকট সৃষ্টি করবে বলে তারা মনে করেন।
ফখরুল বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করা দরকার, সরকার তাতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন রাশিয়া এনিয়ে আলোচনাই করতে দেয়নি, চীন নিরাপত্তা পরিষদে কোন রেজুলেশন নিতে দেয়নি। ভারত এখন পর্যন্ত তাদের কোন ভূমিকা পালন করছে না। তাছাড়া ভাসানচরে কিছু রোহিঙ্গাকে যে স্থানান্তর করা হয়েছে, এ কারণে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়টা আরো দুর্বল হয়ে গেছে।”
বিএনপি মনে করছে, সরকারের এমন পদক্ষেপের কারণে একদিকে মিয়ানমার সুযোগ পাবে এবং অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে বাংলাদেশের দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে।
১২ ডিসেম্বর বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়েই মূলত আলোচনা হয়েছে। তবে হঠাৎ করে কেন দলটি এখন এই ইস্যুকে সামনে আনছে-সেই প্রশ্নে দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতাকে তুলে ধরার পরিকল্পনা তাদের দল নিয়েছে। এর অংশ হিসাবে এখন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।
বিএনপির অন্য সূত্রগুলো বলেছেন, দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং তাদের ভাষায় সরকারের কর্তৃত্ববাদী অবস্থান নিয়ে তারা কথা বললেও এতদিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নজরে নেয়নি। এখন হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ সাতটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতিকে বিএনপি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের একটা সুযোগ হিসাবে দেখছে।
অন্যদিকে, রোহিঙ্গা সংকট যেহেতু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর রয়েছে, সেই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আপত্তির পরও সরকার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের পদক্ষেপ নিয়েছে। এই সুযোগ নিয়ে বিএনপি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের কৌশল নিয়েছে বলে দলটির সূত্রগুলো জানিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, “সরকারের ব্যর্থতাগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরার টার্গেট থেকে বিএনপি এখন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বক্তব্য দিয়েছে। ২০১৭ সালে যখন রোহিঙ্গা সংকট নতুন করে শুরু হয়, তখন বিএনপি সেমিনার বা রাউন্ড টেবিল করে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছে। ফলে বিএনপি আগেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলেছে। এখন আমার মনে হয়, সরকারের সামনে অনেকগুলো ইস্যু এসেছে, যেগুলো নিয়ে জনগণের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। সেটাকে সামনে রেখে বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশেই সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরেছে বিএনপি।”
তবে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল বলেছেন, “রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য স্থায়ী সমস্যা যেন না হয়, সেজন্য রোহিঙ্গা ইস্যুকে এই সময়ে সামনে আনা জরুরি হয়ে পড়েছে, যেহেতু এটাকে এখন অব্যাহত সমস্যা মনে করছি। সেটা যদি অ্যাড্রেস করা না হয় এবং সরকারের পক্ষ থেকে যদি যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়া হয়, তাহলে তো স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মাঝে হতাশা দেখা দেবে। সেজন্যই আমরা বক্তব্য দিয়েছি।”
তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন কূটনৈতিক ব্যর্থতার অভিযোগ মানতে রাজি নন। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারকে সহযোগিতার না করার পাল্টা অভিযোগ করেছেন বিএনপির বিরুদ্ধে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘ওনাদের অভিযোগ অলীক (কল্পনাপ্রসূত)। আমরা মিয়ানমারের ওপর বিভিন্ন রকম চাপ সৃষ্টি করেছি। আমরা মনে করি, আমাদের যে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে, এটা সঠিক পথেই আছে।’
বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “তারা তো নালিশের দল। তাদের কাজ শুধু নালিশ করা। তারা এ ব্যাপারে আমাদের কোন সহায়তা করেন নাই। তাদের মুখে এগুলো মানায় না। বাংলাদেশ যে মানবতায় বিশ্বাস করে, সেখানে যেহেতু আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গারা বড় কষ্টে আছে। সম্প্রতি ওখানে বিভিন্ন ক্রিমিনাল অ্যক্টিভিটিও বেড়ে গেছে। এসব কারণে কিছু লোককে ভাসানচরে নিয়ে গেছি। তবে আমাদের একটিই লক্ষ্য। সেটি হচ্ছে, রোহিঙ্গারা তাদের নিজের দেশে গেলে সেখানেই উন্নত জীবন পেতে পারে। সেই প্রচেষ্টাই আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।”
বর্তমানে কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ায় ৩৪টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এক লাখের মতো রোহিঙ্গার জন্য ভাসানচরে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ১৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে সেখানে নেয়া হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশ সরকারের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে। খবর: বিবিসি বাংলা
Leave a Reply