পরীক্ষাভিত্তিক সামষ্টিক মূল্যায়ন হ্রাস করে বিকল্প মূল্যায়ন সুযোগ বাড়ছে নতুন কারিকুলামে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রস্তাবিত ‘প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা’-এর ২.১৬ অনুচ্ছেদে মূল্যায়ন ও রিপোর্টিং ব্যবস্থায় এই রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, গতানুগতিক পরীক্ষাভিত্তিক সামষ্টিক মূল্যায়ন হ্রাস করা হবে। চালু হবে বিকল্প মূল্যায়ন (স্ব-মূল্যায়ন, সহপাঠী বা দল কর্তৃক মূল্যায়ন ইত্যাদি)। এ পদ্ধতিতে মূল্যায়নের মূলনীতি অনুসরণ করে নিশ্চিত করা হবে শিক্ষার্থীর যোগ্যতার মূল্যায়ন। এমনকি মূল্যায়নের ধারাবাহিক রেকর্ড সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা আসবে নতুনত্ব।
বিষয়টি নিয়ে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান গতকাল সোমবার আমাদের সময়কে বলেন, মূল্যায়ন শিক্ষাব্যবস্থার একটি অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিক্ষাক্রম রূপরেখায় মূল্যায়নকে কেবল শিক্ষার্থীর শিখন মূল্যায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা মূল্যায়ন, শিখন পরিবেশের মূল্যায়ন ও সেই সঙ্গে শিখনের মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রচলিত মূল্যায়ন ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে মুখস্থ বিদ্যাভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে সরে এসে বহুমাত্রিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন মাত্রার জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, গুণাবলি ও চেতনা বিকাশের ধারাকে মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়েছে। সব ধরনের শিখন মূল্যায়নের ভিত্তি হবে যোগ্যতা।
প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান বলেন, যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, ও গুণাবলির মধ্যে আন্তঃস¤পর্ক বিবেচনায় নিয়ে যোগ্যতার পরিমাপ করা। কাজেই জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও গুণাবলিকে পৃথকভাবে মূল্যায়ন না করে এ উপাদানগুলোর মিথস্ক্রিয়ায় অর্জিত সক্ষমতার মূল্যায়ন করা জরুরি। নতুন কারিকুলামে মূল্যায়ন নির্দেশকগুলো হচ্ছে- শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বহুমাত্রিক উপায়ে মূল্যায়ন; শিখনের জন্য মূল্যায়ন; মূল্যায়নের মাধ্যমে শিখন; পর্যবেক্ষণ; প্রতিফলনভিত্তিক ও প্রক্রিয়ানির্ভর মূল্যায়ন; ধারাবাহিক মূল্যায়ন; সতীর্থ মূল্যায়ন; অংশীজন মূল্যায়ন; মূল্যায়নে টেকনোলজির (অ্যাপস) ব্যবহার; মূল্যায়নে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের লেখাপড়া পরীক্ষানির্ভর। এখান থেকে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে সরকার- এটি ইতিবাচক। বর্তমানের দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য শুধু জ্ঞান অর্জন করলে চলবে না। অর্জিত জ্ঞানকে পরিবেশ অনুযায়ী অভিযোজনের জন্য প্রয়োগ করার দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গিও অর্জন করতে হবে। কাজেই শিখন কোনো পূর্ব-নির্ধারিত আচরণ হুবহু অর্জন করা নয়, বরং শিক্ষার্থীর সঙ্গে পরিবেশের অবিরাম মিথস্ক্রিয়া যার মাধ্যমে তার বৈশিষ্ট্য ও পারদর্শিতা এবং পরিবেশের উপাদান উভয়ের মধ্যেই পরিবর্তন ঘটবে। এ পদ্ধতি যথাযথ বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার্থী পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের জ্ঞান-দক্ষতা-দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারবে।
এনসিটিবির কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান বলেন, প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি বিশেষত পাবলিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীর মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ মূল্যায়ন করে। তাই প্রচলিত পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি বহাল রেখে শিক্ষাক্রমের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পাশাপাশি দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং গুণাবলি ও মূল্যবোধ অর্জন সম্ভবপর হবে না। তাই পাবলিক পরীক্ষায় সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি শিখনকালীন মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী, দশম শ্রেণির শেষে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। একাদশ শ্রেণি শেষে এবং দ্বাদশ শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সম্মিলিত ফলের ভিত্তিতে চূড়ান্ত ফল নির্ধারিত করার ভাবনা রয়েছে এটি চূড়ান্ত না বলে জানান এ কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, এখন মাত্র একটা রূপরেখা করেছি বিস্তারিত অনেক কাজ করতে হবে। সেখানে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। নিচের স্তরগুলো নিয়ে বিস্তারিত কাজ শুরু করেছি।
প্রস্তাবিত রূপরেখা অনুযায়ী, দশম শ্রেণির ১০টি বিষয়ের মধ্যে ৫টি বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান) সামষ্টিক মূল্যায়ন ও শিখনকালীন মূল্যায়ন উভয়ের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীকে ম্যূলায়ন করা হবে। অবশিষ্ট ৫টি থিমভিত্তিক বিষয় (জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ভালো থাকা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি) বিদ্যালয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। ৯ম-১০ম শ্রেণির মূল্যায়ন হবে ৫০ নম্বর শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন ৫০ নম্বরের। ৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ নম্বরের এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ নম্বরের। ৪র্থ-৫ম শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৭০ নম্বরের সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৩০ নম্বরের। ১ম-৩য় শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ১০০ নম্বরের কোনো পরীক্ষা হবে না। অনুরূপ প্রাক-প্রাথমিকেও ১০০ নম্বরের শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। অর্থাৎ প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণিতে যে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে তা নিরুৎসাহিত করে পাবলিক পরীক্ষা দশম শ্রেণিতে নেওয়ার রূপরেখা দিয়েছে এনসিটিবি।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, পঞ্চম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষার কথা তো আমাদের শিক্ষানীতিতে উল্লেখ নেই। আমরা সব সময় বলে আসছি, শিক্ষার্থীর বইয়ের বোঝা আর পরীক্ষা চাপ কমাতে হবে। নতুন কারিকুলামেও এ স্তরে পাবলিক পরীক্ষার কথা উল্লেখ নেই। আমরাও চাই এ পরীক্ষা না থাকুক। আমাদের জিপিএ-৫ বলে যে অভিভাবকদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা চলে কার ছেলেমেয়ে কত জিপিএ পাবে। তারা দিনভর প্রাইভেট কোচিং নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেন। এ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
নতুন কারিকুলামের রূপরেখা অনুযায়ী, বিভিন্ন পর্যায় ও স্তরের শিখন-শেখানো কৌশল নির্ভর করবে শিক্ষার্থীর শিখন চাহিদা, বিকাশের পর্যায় ও আগ্রহের ওপর। প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত শিখন-শেখানো কৌশল প্রধানত হবে খেলা, ক্রিয়াকলাপভিত্তিক ও অনুসন্ধানমূলক। টিম টিচিং বা ব্লক টিচিংকে উৎসাহিত করা হবে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন খেলা ও কাজের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে শিখনে অংশগ্রহণ করবে এবং আনন্দের সঙ্গে জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, গুণাবলি ও চেতনার উন্নয়ন ঘটাবে। শিখন-শেখানো পদ্ধতির অংশ হিসেবে প্রধানত গাঠনিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন নিশ্চিত করা হবে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিখন-শেখানো কৌশলের পরিসর হবে আর একটু বৃহত্তর ও সমন্বিত। শিক্ষার্থীদের শিখনে খেলা ও হাতেকলমে কাজের পাশাপাশি অনুসন্ধানমূলক শিখন ও সমস্যা সমাধানমূলক শিখনকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিখন-শেখানো কৌশল হবে আরও সংগঠিত। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ের শিখন পরিচালিত হবে। সব শ্রেণিতে বিভিন্ন শিখন-শেখানো কৌশল প্রয়োগের পাশাপাশি সুসংগঠিত অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন-শেখানো কৌশলের (প্রজেক্টভিত্তিক শিখন) মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উঁচু স্তরের চিন্তন দক্ষতা অনুশীলনের ব্যবস্থা থাকবে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিখন-শেখানো কৌশল বাস্তবায়নে প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষকের ব্যবস্থা থাকবে। শিখন-শেখানো কৌশল হবে বিশেষত অভিজ্ঞতাভিত্তিক। শিখন-শেখানো কৌশল বিষয়বস্তুনির্ভর না হয়ে হবে প্রক্রিয়ানির্ভর। শিখন-শেখানো কৌশলে প্রয়োজন ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী হাতেকলমে শিখন, প্রজেক্ট এবং সমস্যাভিত্তিক শিখন, সহযোগিতামূলক শিখন, অনুসন্ধানভিত্তিক শিখন, স্ব-প্রণোদিত শিখনের সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হবে, পাশাপাশি অনলাইন শিখনের ব্যবহারও উৎসাহিত করা হবে। নির্দিষ্ট যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে সব শ্রেণিতে প্রয়োজন ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের শিখন কৌশল অনুসৃত হবে।
Leave a Reply