জেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দলের কারণে প্রায়ই নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে। এতে মানুষের মনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। তাই জেলা আওয়ামী লীগে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর হচ্ছে কেন্দ্র।
দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, জেলা পর্যায়ে দলে বিশৃঙ্খলা তৈরি, কোন্দলে ইন্ধন এবং দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের হাইকমান্ড। দলের কেন্দ্র থেকে একাধিকবার সতর্ক করে দেওয়ার পরও যারা এখনো নির্দেশ অমান্য করছেন তাদের সবার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।তারা বলছেন, নরসিংদী ও সিরাজগঞ্জ জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তৃণমূলে কঠোর বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। সারাদেশের অন্যান্য জেলায় এ রকম অভিযোগ থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও এই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, কেউ দলীয় শৃঙ্খলা বা আনুগত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ নীতি ও শৃঙ্খলার বিষয়। সারাদেশে এই ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা- তিনি বলেন, অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল রবিবার সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল লতিফ বিশ্বাস এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ডা. হাবিবে মিল্লাত এমপিকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভাপতির নির্দেশক্রমে ও সংগঠনের গঠনতন্ত্রের বিধি অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদককে স্বীয় পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। পরবর্তী কাউন্সিল না হওয়া পর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কেএম হোসেন আলী হাসানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ তালুকদারকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করেছে। ঠিক কী কারণে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তা ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়নি।
স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে দুভাগে বিভক্ত। দলের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চেয়ে নিজেদের এজেন্ডাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছেন নেতারা। নেতাদের কোন্দলের জের ধরে সিরাজগঞ্জে বিভিন্ন সময় হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।
গত ৬ জুলাই দলীয় কোন্দলের জেরে প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরে আরেক ছাত্রলীগ নেতা এনামুল হক বিজয় নিহত হন। পরে জেলা ছাত্রলীগের একাংশ জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। এই বিক্ষোভের নেপথ্যে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ইন্দনদাতা হিসেবে কাজ করেন।
গত ১২ অক্টোবর সিরাজগঞ্জ-১ উপনির্বাচন ঘিরেও জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কোন্দল ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে। উপনির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন তিনজন। এই তিন প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এর সূত্র ধরে দফায় দফায় মারামারিও হয়।
সিরাজগঞ্জ জেলার এক আওয়ামী লীগ নেতা আমাদের সময়কে বলেন, সেখানে প্রায় এক দশক ধরে কোন্দল রয়েছে। ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্নার সঙ্গে জেলার সাবেক সভাপতি সদ্য প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের দ্বন্দ্ব ছিল। সদ্য অব্যাহতি পাওয়া সভাপতি সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ^াসের সঙ্গেও হাবিবে মিল্লাতের দ্বন্দ্ব রয়েছে।
গত ১৯ নভেম্বর দলে বিশৃঙ্খলায় পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ এনে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরু ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়াকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জিএম তালেবকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পীরজাদা কাজী মো. আলীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এত দিন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দ্বন্দ্বে দুভাগে বিভক্ত ছিলেন। শীর্ষ নেতৃত্বের কোন্দল এমন পর্যায়ে ছিল যে, দলীয় সভা-সমাবেশেও তারা এক মঞ্চে আসেননি। গত জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে এই বিভাজন আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
গত ৮ মার্চ নরসিংদীর মনোহরদীতে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের বাসায় দলের জরুরি বর্ধিত সভা হয়। এ সময় নিজেদের বিভেদ ভুলে দুজনকে একসঙ্গে কাজ করতে নির্দেশ দেন দলটির ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। পরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সবার সামনে মিলিয়ে দেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি, যে যার মতোই চলছেন।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাজ হচ্ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করা। কর্মসূচি ও সভা-সমাবেশের মাধ্যমে দলের কার্যক্রম প্রচার ও দলকে জনপ্রিয় করে তোলা। যারা এটা না করে নিজেদের বলয় তৈরি করছেন বা দলে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন তাদের জন্য এই অব্যাহতি একটি বার্তা।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা সুচারুভাবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে দলেও পূর্ণ মনোযোগী। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি প্রতিনিয়ত তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। তৃণমূল নেতাদের খোঁজ-খবর রাখেন। ফলে দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করলে নেত্রী তাদের বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন, এটিই স্বাভাবিক।
Leave a Reply