চট্টগ্রাম শহর ও আশপাশের এলাকায় ইয়াবার চালান ধরা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হলেও গত কিছুদিন ধরে বড় বড় চালান ধরা পড়ছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, ন্যূনতম ৫ হাজারের নিচে চালানই ধরা পড়ছে না। এর মধ্যে গত শনিবার গভীর রাতে কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট এলাকা থেকে ১ লাখ ৪৮ হাজার ইয়াবা জব্দ করেছে পুলিশ। মিয়ানমার থেকে মাছ ধরার ট্রলারে করে আনা ইয়াবাগুলো সরাসরি কালুরঘাটে এনে খালাস করা হচ্ছিল।
এর আগে ওই পথে ইয়াবা ধরা পড়েনি। এই ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নগরীর চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আতাউর রহমান খোন্দকার বলেন, গ্রেপ্তার সোহেলের তদারকিতে ইয়াবাগুলো খালাস হয়। দুটি ড্রামে ইয়াবাগুলো রেখে তিনি ট্রাক ভাড়া করার জন্য রাস্তায় দাঁড়ান। সোহেল জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে ইয়াবাগুলো সরাসরি একটি ফিশিং ট্রলারে করে কর্ণফুলী নদীর ঘাটে আনা হয়।
এ আগে ১০ নভেম্বর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে এক রোহিঙ্গা দম্পতিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাদের কাছে ইয়াবা বিক্রির এক কোটি ১৭ লাখ ১ হাজার ৫০০ টাকা ও ৫৩০০ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। র্যাব, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর পাচার করা ইয়াবা জব্দ করে আসছে। এর মধ্যে র্যাব-৭ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে গত দুই মাসে কী পরিমাণ ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে, সে তথ্য পাওয়া গেলেও অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে জব্দ করার তালিকা পাওয়া যায়নি।
গত অক্টোবর ও চলতি মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত র্যাব-৭ ইয়াবা জব্দ করেছে ৪ লাখ ৬২ হাজার ৬৩২ পিস। এর মধ্যে অক্টোবরে ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৮২ পিস ও ২২ নভেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ৭৬ হাজার ৭৫০ পিস। ৫২ দিনে ইয়াবা পাচার করার অপরাধে গ্রেপ্তার করেছে ১০৮ জনকে। এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অক্টোরে দুই লাখ ৪২ হাজার ও নভেম্বরের ২২ তারিখ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ ইয়াবা জব্দ করেছে।
জানা যায়, গত কয়েক বছরে ইয়াবার চালান বিশি আটক করা হয়েছিল ২০১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন টেকনাফের নাফ নদী থেকে নৌবাহিনীর অভিযানে ১৮ লাখ ইয়াবা জব্দ করা হয়েছিল। এ ছাড়া গত ২৫ ফেব্রুয়ারি চার বছর আগে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ট্রলার থেকে প্রায় ২৮ লাখ ইয়াবা উদ্ধারের মামলায় তিন আসামিকে ১৫ বছরের কারাদ- দিয়েছেন চট্টগ্রামের একটি আদালত। জামিন অযোগ্য মামলা হলেও প্রতিদিন চট্টগ্রামের কোনো না কোনো স্থানে ইয়াবাসহ পাচারকারী গ্রেপ্তার হচ্ছেন। চট্টগ্রাম
র্যাব ৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মু. মশিউর রহমান জুয়েল আমাদের সময়কে বলেন, ২০১৭-১৮ কিংবা ২০১৯ সালে যেভাবে ইয়াবা ধরা পড়ত এখন সেভাবে পড়ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় অনেকটা কমেছে। আমাদের পক্ষ থেকে ইয়াবার বিষয়ে শূন্য সহনশীলতা (জিরো টলারেন্স) নীতি অনুসর করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দুটি কারণে ইয়াবা পাচার বন্ধ হচ্ছে না। প্রথমত. মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবার প্রচুর চাহিদা। দ্বিতীয়ত. অল্প বিনিয়োগ করে দশগুণ টাকা লাভ করা যায়। কেউ যদি এক হাজার ইয়াবা কক্সবাজার থেকে ঢাকায় নিয়ে যেতে পারে, তা হলে এক লাখ টাকা তার লাভ হয়। আর এটা বহন করতেও সুবিধা। যার ফলে ইায়াবা পাচার থামছে না।
চট্টগ্রামের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারী আমাদের সময়কে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকেই অধিকাংশ ইয়াবা চালান দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। করোনার কারণে লকডাউনের সময় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় পাচারকারীরা ইয়াবা পাচার করতে পারেনি; কিন্তু যখনই যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হলো, তখনই তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে ইয়াবা পাচার করে আসছে। সেসব কারণে জেলার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট; গোয়েন্দা দলকে করা হয়েছে আরও বেশি সক্রিয়।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রাম জেলা কমিটি সভাপতি অ্যাডভোকেট আকতার কবীর চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, যেসব রুট দিয়ে ইয়াবা আসছে, সেগুলো আগে সুরক্ষিত করতে হবে। সীমান্ত সুরক্ষিত করতে না পারলে, আর চাহিদা কমাতে না পারলে; ইয়াবার পাচার বন্ধ হবে না। এদিক-ওদিক থেকে দুই-একটা চালান ধরে ইয়াবার কারবার বন্ধ করা সম্ভব হবে না, যদি না আমরা এই দুটি বিষয়ে গুরুত্ব না দিই। এ ছাড়া ইয়াবা পাচারে যারা ধরা পড়ছে তারা কর্মী। মূল হোতা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। মূল হোতাকে আইনের আওতায় আনা গেলে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
Leave a Reply