ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মৃত ঘোষণার পর দাফনের সময় এক মেয়ে নবজাতকের নড়েচড়ে ওঠার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সে প্রতিবেদনের সূত্র ধরে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ওই ঘটনায় চিকিৎসকদের ‘ব্যর্থতা ছিল’, তবে শিশুটি ও তার মাকে বাঁচাতে চিকিৎসকসহ সবারই চেষ্টায় কোনো ঘাটতি ছিল না। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢামেকের সভাকক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন হাসপাতালের নতুন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক ও উপপরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ।
পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, শাহিনুর বেগম নামে ওই রোগী যখন হাসপাতালে ভর্তি হন, তখনই তার অবস্থা ভালো ছিল না। ধীরে ধীরে তা আরও খারাপের দিকে যায়। চিকিৎসকরা তার বাচ্চা প্রসবের চেষ্টা চালান। বাচ্চাটি ২৬ সপ্তাহের অপরিণত বয়সে ভূমিষ্ঠ হয়। মায়ের গর্ভে ২৮ সপ্তাহ পার হলে শিশু বেঁচে থাকার মতো পরিপূর্ণ বয়স পায়। তবে এ বাচ্চাটি জীবিত থাকার আগের বয়সেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর চিকিৎসক ও নার্স নিয়ম অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ করেছে। তবে নবজাতকটির মধ্যে তারা জীবনের লক্ষণ পাননি। ঘণ্টাখানেক অবজারভেশনেও রাখা হয় নবজাতকটিকে। পরে মৃত ঘোষণা করে স্বজনদের কাছে দেওয়া হয়। এর পরও ৪-৫ ঘণ্টা নবজাতকটি তাদের কাছেই ছিল। পরে দাফনের জন্য নিয়ে গেলে সেখানে শিশুটি নড়েচড়ে উঠলে আবার তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। বিষয়টি জানার পর দ্রুত এনআইসিইউ ম্যানেজ করে সেখানে রাখা হয় তাকে।
একেএম নাসির উদ্দিন আরও বলেন, ঘটনার পরপরই বিষয়টি তদন্তে ৪ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। সেই কমিটিই আজ (মঙ্গলবার) তাদের প্রতিবেদন ও কিছু সুপারিশ জমা দিয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে জন্মের পর নবজাতকটির মধ্যে জীবনের কোনো লক্ষণ ছিল না। এটি একটি বিরল ঘটনা। তবে চিকিৎসকদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। মা ও মেয়ে দুজনকেই বাঁচানোর চেষ্টা ছিল তাদের। অনাকাক্সিক্ষতভাবে এমনটি হয়েছে। তবে এখানে চিকিৎসকদের ব্যর্থতা রয়েছে। যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। এ ঘটনায় রিটও হয়েছে আদালতে। সেখান থেকে আরও যদি তদন্ত করার বিষয় আসে, তা হলে সেটিও করা হবে। এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়, অনেক দেশেই এমন ঘটনা ঘটেছে। এটি একটি অপরিণত বয়সের শিশু ছিল। এমন ঘটনা অপরিণত বয়সের শিশু, সাপে কাটা রোগী, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের রোগীর ক্ষেত্রে ঘটে।
এক প্রশ্নের জবাবে পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, ওই শিশুটির ক্ষেত্রেও তার সবই করা হয়েছিল। তবুও চিকিৎসকরা নবজাতকটির মধ্যে জীবনের লক্ষণ পাননি। ওই সময় যে চিকিৎসক ও নার্সরা কাজ করেছে তারা হয়তো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন আগে হননি। তবে তারা আরও কিছু চেষ্টা করতে পারতেন। হয়তো তা করেননি বা বুঝতে পারেননি। এ ঘটনায় কারও অবহেলা, দায়িত্বহীনতা তদন্তে পাওয়া যায়নি। তারা কয়েক দফায় প্রচেষ্টা করেছিলেন। তবে তা শতভাগ ছিল না, তার মানে তাদের ব্যর্থতা ছিল। তবে ইচ্ছাকৃত অবহেলা ছিল না।
তদন্ত কমিটির প্রধান হাসপাতালটির নবজাতক ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক মনিষা ব্যানার্জি বলেন, নবজাতকটির বেঁচে যাওয়া যেমন মিরাকল, তেমনই এখন বাঁচানোও মিরাকল। আমাদের দেশে ২৮ সাপ্তাহের কোনো শিশু ভূমিষ্ট হলে তাকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। আর এ শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে ২৬ সপ্তাহে। আমরা তাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। শিশুটিকে এখন অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি এন্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে ও স্যালাইন চলছে। সে আগের চেয়ে ভালো আছে। আজ (মঙ্গলবার) তাকে মুখে খাবার খাওয়ানো শুরু করব। তবে এ ধরনের বাচ্চাদের যে কোনো সময় অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে। শিশুটি বেঁচে গেলে তা হবে মিরাকল। আমরা আশাবাদী। তবে এখনো ইনফেকশনের চান্স রয়েছে। শিশুটি এখনো সংকটাপন্নই বলা যায়। শিশুটির জন্য সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন অধ্যাপক মনিষা।
গত শুক্রবার ভোরে ঢামেকের গাইনি বিভাগে শাহিনুর বেগম নামে এক গৃহবধূ অপরিণত বয়সের ওই কন্যাশিশুটির জন্ম দেন। সে সময় চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, বাচ্চাটি মৃত অবস্থাতেই জন্মেছে। এর পর হাসপাতালের আয়া বাচ্চাটিকে প্যাকেট করে বেডের নিচে রেখে দেন এবং কোথাও নিয়ে দাফনের জন্য বলেন। পরে স্বজনরা রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শিশুটিকে দানের জন্য নিয়ে যায়। কবর খোঁড়া যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন সবাইকে অবাক করে শিশুটি কেঁদে ওঠে। বাচ্চাটির বাবা লাশের প্যাকেট খুলে দেখেন তার সন্তান নড়াচড়া করছে ও কান্নাকাটি করছে। এর পরই তাকে দ্রুত আবার ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন। পরিবার মিরাকল এ শিশুটির নাম রেখেছে মরিয়ম।
Leave a Reply