মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নভেম্বর মাসের তিন তারিখ। প্রচারাভিযান এখন প্রায় শেষ পর্বে। কিন্তু এখনো যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ভোটার রয়ে গেছেন যারা এখনো সিদ্ধান্ত নেননি কাকে ভোট দেবেন।
রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় শিবির থেকেই বলা হচ্ছে, ২০২০ সালের এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হচ্ছে ভোটারদের জীবনকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন।
তারা প্রচারাভিযানের জন্য গত কয়েক সপ্তাহে যে পরিমাণ অর্থ তুলছে তা-ও নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন – এবার নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়বে। তবে অনেক ভোটারই নিশ্চিত নন যে তারা ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন বা অন্য কাউকেই ভোট দেবেন কিনা।
এখানে বলে রাখা দরকার, এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প ও বাইডেন ছাড়াও আরো যে প্রার্থীরা আছেন তারা হলেন, লিবার্টারিয়ান পার্টির জো ইয়র্গেনসেন, গ্রিন পার্টির হাওয়ি হকিন্স, বার্থডে পার্টির কানিয়ে ওয়েস্ট, এ্যালায়েন্স এ্যান্ড রিফর্ম পার্টির রকি দে লা ফুয়েন্তে, ও কনস্টিটিউশন পার্টির ডন ব্ল্যাংকেনশিপ।
‘আমাদের কোনো ভালো প্রার্থী নেই’
“আমি এই নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি” – বলছিলেন হিউস্টনের ৩২-বছর বয়স্ক সাইকিয়াট্রিক নার্স সামিয়ান কাজী ।
“আমাদের ভালো কোন প্রার্থী নেই। এদেশের সুন্দর ভবিষ্যতের আশা জাগবে বা মানুষের জীবন উন্নত হবে, এমন কোন কিছুই আমরা এই প্রার্থীদের কাছ থেকে পাচ্ছিনা।”
মি. কাজী বলছিলেন, তিনি আগেকার নির্বাচনগুলোতে নিয়মিত ভোট দিয়েছেন। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আর ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে তিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকেই ভোট দিয়েছেন।
এবছর তার পছন্দের প্রার্থী ছিলেন বার্নি স্যাণ্ডার্স। কিন্তু ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী নির্বাচনে এই বামপন্থী প্রার্থী হেরে গিয়েছিলেন।
এর পর থেকে মি. কাজী অনেকটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
তিনি বলছেন, “সমাজের যে ক্ষমতাবানরা এদেশে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে – তারা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ হুমকির মুখে পড়ুক তা চায়না।”
“আসলে আমেরিকা এখনো একটি গণতান্ত্রিক দেশ হতে চাইছে কিনা এটাই আমার সন্দেহ হয়। এ দেশটি আসলে একটি প্লুটোক্রেসি বা ধনিকতন্ত্র। ধনীদের নিয়ন্ত্রণ হুমকির মুখে ফেলতে পারে এমন কোন কাঠামোগত বা অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কথা এখানে নিষিদ্ধ, কেউ এমন কিছু করতে চাইলেই তাকে সরিয়ে দেয়া হবে। ”
রাজনীতির ব্যাপারে অনাগ্রহ বা বিচ্ছিন্নতাবোধের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোটারদের ভোট দেয়ার হার বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় কমে গেছে। এখানে ৫০% থেকে ৬০% ভোটার ভোট দিতে যান।
অন্যদিকে, ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভোটার উপস্থিতির হার প্রায় ৭০%। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক উন্নয়নশীল দেশেও ভোটার উপস্থিতির উচ্চতর হার দেখা যায়।
বারাক ওবামা ও জন ম্যাককেইনের মধ্যে ২০০৮ সালের ভোটযুদ্ধে প্রায় ৬৪% ভোটার ভোট দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন মাত্র ৫৫% ভোটার।
প্রায় অর্ধেক আমেরিকান ভোটারই ভোট দেন না
ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোটারদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নিয়মিতভাবে ভোট দেন না। সংখ্যার হিসেবে এর পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি ।
এই জরিপটি করেছে নাইট ফাউন্ডেশন নামে একটি অলাভজনক বামঘেঁষা প্রতিষ্ঠান।
“এটা এক বিশাল জনগোষ্ঠী। দেশের অর্ধেক। তাই এর মধ্যে সব রকম লোকই আছে,” বলছেন টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক, এবং নাইটস ফাউন্ডেশনের একজন উপদেষ্টা আইটান হার্শ।
“জনগণের এই বিচ্ছিন্নতার অর্থ হচ্ছে তারা নির্বাচন পদ্ধতির সাথে নিজেদের যুক্ত বলে মনে করছে না, এতে কিছু আসে যায় বলেও মনে করছে না।”
বেলজিয়াম এবং চিলির মতো যেসব দেশে ভোটার উপস্থিতির উচ্চহার দেখা যায়, সেখানে ভোট দেয়াকে একধরণের বাধ্যতামূলক করা হয়েছে – আর তাতে কাজও হয়েছে নাটকীয়ভাবে।
অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানির মতো অন্য কিছু দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বা অন্য উদ্যোগ নিয়ে ভোটার নিবন্ধন করে নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রে অবশ্য ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করা এবং ভোট দিতে যাওয়া অনেকটাই ব্যক্তিগত দায়িত্বের মত।
গত কয়েক দশক ধরে অনেক রাজ্যই ভোট দেবার ক্ষেত্রে অনেক নতুন সুবিধা দিচ্ছে। এর মধ্যে আছে একদিনে ভোটার রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ, বেশি সময়ের জন্য ভোটকেন্দ্র খোলা রাখা এবং আগাম ভোট দেয়া, বা ডাকযোগে ভোট দেবার মতো বিকল্প পথ সম্প্রসারিত করা।
তবে মি. হার্শ বলছেন, ভোট দেবার সুযোগ বাড়ানো হলেও তা ভোটারদের অংশগ্রহণের ওপর তেমন কোন প্রভাব ফেলছে না। তিনি বলছেন, “কেন লোকের ভোট দিতে আসার হার কম – তা যদি আপনি বড় পরিসরে দেখতে চান তাহলে আমি বলবো, এর পেছনে আছে মানুষ আগ্রহ কি নিয়ে এবং কোন বিষয়গুলো তাদের উদ্বুদ্ধ করে।”
অনেকেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন
অধ্যাপক হার্শ বলছেন, আমেরিকা যত বেশি জাতীয়তাবাদী এবং দলবাজ হয়ে উঠবে – ততই হয়তো আরো বেশি মানুষ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যাবে।
“আগে এমন ছিল যে অঙ্গরাজ্য স্তরে আপনার ভোটের সাথে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আপনি কাকে ভোট দিচ্ছেন তার কোন সম্পর্ক ছিল না – কারণ এগুলো ছিল ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। কিন্তু এখন একটা শহরের কাউন্সিলের ভোটও হয়তো মানুষের মনে ট্রাম্পের ওপর গণভোটের চেহারা নিতে পারে।”
তিনি বলছেন, “রাজনীতিকে যদি ভালো আর মন্দের মধ্যে একটা যুদ্ধে পরিণত করা হয় তাহলে অনেক লোকই তাতে আর আগ্রহ বোধ করে না। এটা অনেকটা খেলার মতো। যারা এটা পছন্দ করে – যতই এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ওপর জোর দেয়া হবে ততই তারা রাজনীতিতে আরো বেশি মজা পাবে। কিন্তু অন্যদের কাছে মনে হবে এটা একটা অদ্ভূত জগত যা তাদের জন্য নয়।”
র্যান্ট পাপাজিয়ান তাদের একজন।
তিনি একজন আর্মেনিয়ান অভিবাসী, যিনি বেড়ে উঠেছিলেন লেবাননে – সেখানকার তিন দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধের সময়। তার বয়স যখন ১৮ পার হয় তখন থেকে তিনি ক্যালিফোর্নিয়াতেই আছেন, এবং তিনি কখনো ভোট দেন না।
“ভোট দিলে হয়তো আপনার নিজেকে ক্ষমতাবান বোধ হতে পারে, কিন্তু এতে স্থিতাবস্থা বদল হয় না।,” বলেন তিনি, “আমার মনে হয় এমন প্রার্থী কখনোই এসব নির্বাচনে পাওয়া যাবে না যারা সামাজিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আগ্রহী।এই পদ্ধতিতে এমন রাজনীতিবিদও তৈরি হবে না যাদের আমি আস্থার সাথে ভোট দিতে পাবো।”
কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষক পাপাজিয়ান জানেন যে ভোটের ব্যাপারে তার এসব ভাবনাচিন্তা বৈপ্লবিক। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরোধী।
তার মতে, “গণতন্ত্র ক্রমাগত আরো উন্নত হবে বলেই মনে করা হয় কিন্তু আসলে এখন উল্টোটা হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে তত এটা আরো খারাপ হচ্ছে। দেশ যত বড় হচ্ছে ততই এটা ছোট ছোট উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাতে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজতর হচ্ছে, আমরা যে ক্রমাগত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছি তা-ও অব্যাহত থাকছে।”
“আমাদের জন্য প্রকৃত পরিবর্তনের পথ একটাই – তা হলো বয়কট করা।”
মোহভঙ্গ
এবারই প্রথম ভোট দিচ্ছেন এমন কিছু ভোটারের ইতিমধ্যেই এ পদ্ধতির ব্যাপারে ‘মোহভঙ্গ’ হয়েছে।
উইসকনসিন রাজ্যের কলেজ ছাত্রী ২০ বছরের গ্রেস লিংক এই প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে চান। কিন্তু তিনি প্রার্থীদের নিয়ে সন্তুষ্ট নন।
গ্রেস বলছেন, “টাকা আর দলের ভেতরকার শক্তি কিভাবে তরুণদের দমন করার জন্য ভূমিকা রাখছে তা এখন খুবই স্পষ্ট। আমাদেরকে এমনভাবে চালিত করা হচ্ছে যেন আমরা বাইডেন বা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বেছে নেয়া কাউকে ভোট দেই। অথচ প্রাইমারির পুরো সময়টা জুড়ে তরুণদের উপেক্ষা করা হয়েছে।”
লিংক বলছেন, জো বাইডেনকে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী করার মধ্যে দিয়ে শ্বেতাঙ্গ উচ্চবিত্ত শ্রেণীর প্রয়োজনকেই বড় করে দেখা হয়েছে। তরুণ ভোটার – যারা ক্রমবর্ধমান ছাত্র ঋণের মতো সমস্যার মধ্যে রয়েছে – তাদের গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
তিনি বলছেন, “এ ব্যাপারে যুক্তি দেয়া হচ্ছে যে বাইডেনকে আরো বামদিকে ঠেলে দেয়া যেতে পারে, কিন্তু ট্রাম্পকে তা করা যাবে না।”
“আগামী চার বছর হয়তো স্বল্পমেয়াদে অপেক্ষাকৃত ভালো যেতে পারে – কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বড় কোন পরিবর্তন আসবে না। ”
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply