একের পর এক প্রতিবন্ধকতার মুখে বিপর্যস্ত দেশের দুগ্ধ খামারিরা। সাধারণ ছুটি শেষে সব কিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও হাসি ফেরেনি তাদের মুখে। করোনা ও বন্যাকালীন আর্থিক ক্ষতি, গবাদিপশু পালন খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় খামার টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে ঋণ করে চলছেন কেউ কেউ। আবার টানা লোকসানের মুখে হার মেনেছেন অনেকেই, পুঁজি হারিয়ে খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
জানা যায়, বর্তমানে দেশের বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ দুধই সরবরাহ করছেন খামারিরা। বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৯৯ লাখ টন লিটার। দেশজুড়ে এ খাতে জড়িত রয়েছেন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ খামারি। তবে করোনাকালে লকডাউন পরিস্থিতিতে প্রতিদিন গড়ে ১২০ থেকে ১৫০ লাখ লিটার দুধ অবিক্রীত থাকায় বড় আর্থিক ক্ষতিতে পড়েন তারা। এ সময় প্রতিদিন আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭০ কোটি টাকায় পৌঁছে। সাধারণ ছুটি শেষে দুধ বিক্রি আগের তুলনায় কিছুটা বাড়লে আশার আলো দেখেন খামারিরা। কিন্তু বন্যা পরিস্থিতি ও গোখাদ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় তাদের আয়ের থেকে ব্যয়ের পরিমাণই এখন বেশি। এমনিতেই করোনার ক্ষতি কাটিয়ে
উঠতে পারেননি, তার ওপর খামার পরিচালনা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় জীবিকা টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন অনেক খামারি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার প্রকোপে আমদানি বন্ধ থাকায় গোখাদ্যের দাম বেড়ে যায়। ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া গমের ভুসির বস্তার (৩৭ কেজি) দাম বর্তমানে ১১০০ থেকে ১১৫০ টাকা। চালের কুঁড়ার বস্তা (৫০ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ টাকা, যা আগে ছিল ৪৬০ টাকা। ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া বুটের ভুসির বস্তার (২৫ কেজি) দামও হাজার ছাড়িয়েছে। বেড়েছে সয়া মিলের দামও, কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়ে এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায়। অন্যদিকে বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে কাঁচা ঘাসও মিলছে কম। বাধ্য হয়ে পশু পালনে বেশি দামের দানাদার খাদ্যের ওপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে খামারিদের। এতে খামার পরিচালনা খরচ বেড়েছে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজের খামার নিয়ে বিপাকে আছেন রংপুর ইওন ডেইরি ফার্মের কর্ণধার মোমিন-উদ-দৌলাও, ‘পাঁচ কেজি ঘাসের বিপরীতে অন্তত এক কেজি দানাদার খাবার দিতে হয় গরুকে। কিন্তু দানাদার খাবারের দাম বেড়ে যাওয়া খামারের ব্যয় বেড়ে গেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অথচ আয় বাড়েনি। করোনাকালীন থেকে এখনো লোকসানেই চলছে খামার।’ মোমিন আরও বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে আমার খামারে দৈনিক প্রায় আড়াই হাজার লিটার দুধ বিক্রি হয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে বাজারে তরল দুধের চাহিদা কমে যায়। ফলে বিক্রিও কমে গেছে অনেক। এমন অবস্থায় খামারে আয়ের থেকে ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। এটি টিকিয়ে রাখতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাকে। আগামী দিনগুলো নিয়েও শঙ্কায় রয়েছি।’
লোকসানের সময়ে গোখাদ্যের দাম নিয়ে হতাশ সাভারের ছোট খামারি মো. মজনু তালুকদারও। তাই বাধ্য হয়ে গরু বিক্রির কথা ভাবছেন। মজনু বলেন, ‘মানুষের জন্য ত্রাণ দেওয়া হয়। অথচ বোবা প্রাণী গবাদিপশুদের ত্রাণ দেওয়া হয় না। এমনিতেই করোনায় আয়-ইনকাম বন্ধ ছিল, তার ওপর এখন খরচ বেড়ে গেছে। কীভাবে খামার টিকিয়ে রাখব? সরকার যদি ন্যায্যমূল্যে গোখাদ্যের ব্যবস্থা করে দিত, তা হলে অনেক খামারি তাদের খামার টিকিয়ে রাখতে পারতেন। তাদের আর গবাদিপশু বিক্রি করতে হতো না।’
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ইমরান হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘করোনাকালীন প্রতিমাসে দুগ্ধ খাতে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এর পরও অনেকে ঋণ করে তাদের খামার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু বর্তমানে গোখাদ্য ও কর্মচারীদের বেতনভাতাসহ পরিচালনা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সবাই হিমশিম খাচ্ছেন। তাই বাধ্য হয়ে গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন অনেকেই। তালা ঝুলছে খামারে খামারে।’
একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে ইমরান আরও বলেন, ‘অন্তত পাঁচটি গাভী আছে যাদের খামারে, তাদের খামারি হিসেবে গণ্য করা হয়। সে অনুযায়ী দেশে বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ দুগ্ধ খামারি রয়েছেন। এর মধ্যে গত তিন মাসে অন্তত ১৫ শতাংশই তাদের খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এর বাইরে পাঁচটির কম গবাদিপশু পালনকারী অসংখ্য প্রান্তিক খামারির সংখ্যাও কম নয়, যাদের অনেকে গোখাদ্যের খরচ পোষাতে না পেরে গরু বিক্রি করে দিয়েছেন।’
Leave a Reply