1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৯ পূর্বাহ্ন

ঢাকায় কিডনি পাচারকারী চক্রের নতুন নেটওয়ার্ক

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০২০

ভেজাল খাদ্যের বিষক্রিয়াসহ নানা কারণে প্রতিদিনই বাড়ছে কিডনি রোগীর সংখ্যা। এ রোগীদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে দেশব্যাপী সক্রিয় ভয়ঙ্কর কিডনি পাচারচক্র। তাদের টার্গেট ঋণগ্রস্ত গরিব বা নিম্নবিত্ত কিংবা আর্থিক সংকটে থাকা মানুষ। দারিদ্র্য ও অসচেতনতা, সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বল নজরদারির সুযোগ নিয়ে তারা ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে মোটা অঙ্কের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে ঢাকায় এনে তাদের কিডনি কেটে রাখছে। ক্ষেত্রবিশেষ কিডনিদাতাকে বিদেশে নিয়েও অঙ্গ কেনাবেচা করছে।

রোগীর আত্মীয়ের ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের দেখাচ্ছে দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্কের জাল কাগজপত্র। রোগীর সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা দেখে এক কিডনি প্রতিস্থাপনে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে ১০ লাখ টাকা থেকে অর্ধ কোটি টাকা পর্যন্ত। আর চক্রের দালালরা দুই পক্ষকে মিলিয়ে দিয়ে বিনিময়ে পাচ্ছে ২০ হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকা। এত কিছুর পরও ভয়ঙ্কর এই অপরাধীরা দাতার কিডনি নিয়ে তাকে হত্যার পর নদীতে লাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে এমন উদাহরণও রয়েছে।

মূলত কিডনির মূল ক্রেতাদের অধিকাংশই ঢাকার বাসিন্দা। বসবাস করেন রাজধানীতে। এ কারণে পাচারকারীদের চোখও রাজধানীর দিকে। বছর কয়েক আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কড়া নজরদারির কারণে রাজধানীতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে কিডনি পাচারকারীরা। চক্রের হাতেগোনা কয়েকজন ধরা পড়লেও গডফাদাররা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বছরের পর বছর ধরে তারাই জিইয়ে রেখেছে চক্রের সদস্যদের। এখন ভয়ঙ্কর সেই সদস্যরা ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে খোদ রাজধানীতে।

পুলিশ সূত্র বলছে, মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে বেআইনি এই বেচাকেনায় জড়িত রাজধানীর কিছু হাসপাতালসহ এক শ্রেণির অসাধু চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও বেসরকারি সংস্থা। খোদ ঢাকায় অন্তত ১১টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং সংঘবদ্ধ আটটি চক্র এই কিডনি পাচারের সঙ্গে জড়িত। সারা দেশে আছে ৭০টিরও বেশি চক্র। প্রতিটি দলে নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গড়া পাঁচ থেকে ১০ জন করে সদস্য রয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপেনে রোগীর কাছ থেকে চক্রগুলো মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিলেও অঙ্গ হারিয়ে দরিদ্র কিডনিদাতারা পাচ্ছেন মাত্র ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। প্রতিবাদ করতে না পারায় চক্রের সদস্যরা অনেক ডোনারকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে পুরো টাকাইটাই মেরে দিয়েছে এমন নজির রয়েছে। আবার রোগীদের কিডনি প্রতিস্থাপন না করে তাদের টাকা মেরে দেওয়ার মতো উল্টো চিত্রও রয়েছে।

সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে খোদ রাজধানীতে। গত ১৪ আগস্ট মোহাম্মদপুর থানায় ঘটনার বিষয়ে মামলা (নম্বর-৪২) করেছেন মো. আমিনুল নামে ভুক্তভোগী এক কিডনি রোগী। মামলার সূত্র ধরে পুলিশ রাজধানীর কলাবাগান এলাকা থেকে কিডনি পাচার চক্রের সদস্য রঞ্জিত কুমার বাড়ৈকে (৫০) গ্রেপ্তার করে। তিনি বর্তমানে কারাগারে। এক দিনের রিমান্ডে পুলিশের কাছে ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে কিডনি পাচার চক্রের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন রঞ্জিত কুমার। আমাদের সময়ের অনুসন্ধান ও কিডনি কেনাবেচা সংক্রান্ত বিষয়ে তার সঙ্গে এক রোগীর স্বজনের ফাঁস হওয়া ফোনালাপেও ভয়ঙ্কর এই চক্রের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। ওই অডিও ক্লিপ (দুটি) এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে।

জানা গেছে, শুধু আমিনুলই নয়, কিডনি দেওয়ার কথা বলে আরও কয়েকজন রোগীর লাখ লাখ টাকা মেরে দিয়েছেন রঞ্জিত কুমার। অবৈধভাবে অন্তত আটজনের কিডনি তিনি প্রতিস্থাপন করিয়েছেন নামিদামি বিভিন্ন হাসপাতালে। হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। সবই হয়েছে ভুয়া কাগজপত্রে।

মিরপুরের কল্যাণপুর এলাকার বাসিন্দা মো. আমিনুল মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন- ছয় বছর ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন। ডায়ালিসিস করছেন দুবছর ধরে। মেহেরপুরের তরিকুল নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে পরিচয় হয় রঞ্জিত কুমারের সঙ্গে। রঞ্জিত তাকে জানান, ১৫ লাখ টাকা দিলে আমিনুলের কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য ডোনার সংগ্রহ করে দেবেন। গত ২০ নভেম্বর মোহাম্মদপুরের শ্যামলী ক্লাব মাঠে বসে একটি সাদা কাগজে চুক্তি করে আমিনুলের কাছ থেকে অগ্রিম ৫ লাখ টাকা নেন রঞ্জিত। পরবর্তী সময়ে কিডনি বা কিডনি ডোনার না দিয়ে টালবাহানা করতে থাকেন। এদিকে টাকা ফেরত দিতে চাপ দিলে টাকা দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন রঞ্জিত। উল্টো বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করায় আইনের দারস্থ হন আমিনুল।

এ মামলায় একদিনের রিমান্ড শেষে গত ১৬ আগস্ট রঞ্জিতকে আদালতে হস্তান্তর করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই নেলসন দিপক বাইন। আদালতকে তিনি বলেন, রঞ্জিত কুমার বাড়ৈ কিডনি পাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য। তার বাবার নাম রাম প্রসাদ বাড়ৈ। গ্রামের বাড়ি বরিশালের উজিরপুরের ইন্দুরকানীতে। সপরিবারে থাকেন রাজধানীর কলাবাগান থানাধীন হাতিরপুর সার্কুলার রোডের একটি ফ্ল্যাটে। রঞ্জিত দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কিডনি প্রদান এবং কিডনি ডোনার পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করে আসছিলেন।

এসআই নেলসন দিপক আমাদের সময়কে বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।

ভুক্তভোগী আমিনুল গতকাল শুক্রবার জানান, কিডনি অকেজো হয়ে পড়ায় দিন দিন স্বাস্থ্য খারাপের দিকে যাচ্ছিল তার। কিন্তু টাকার জন্য কিডনি প্রতিস্থাপন করতে পারছিলেন না। এমন প্রেক্ষাপটে রঞ্জিতের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ফেরত পেতে অন্য এক রোগী সেজে কিডনি প্রতিস্থাপন বাবদ অগ্রিম অর্থ দিতে আমিনুলের স্ত্রী শারমিন আক্তার কৌশলে তাদের কল্যাণপুরের বাসায় রঞ্জিতকে ডেকে আনেন। আমিনুলের মুখোমুখি হতেই বিষয়টি বুঝতে পারেন রঞ্জিত। এ নিয়ে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে হাতাহাতি হয় বাসার লোকজনের সঙ্গে। খোলা দরজা পেয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন রঞ্জিত। কিন্তু বাসার অন্যদের তৎপরতায় ব্যর্থ হন।

এদিকে বাসার সামনে ধস্তাধস্তি দেখে এক পথচারী বিষয়টি জানান জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এ। খবর পেয়ে মিরপুর মডেল থানা পুলিশ এসে রঞ্জিতসহ ইমতিয়াজ আহমেদ আনন্দ নামে আমিনুলের পরিচিত একজনকে থানায় নিয়ে যায়। এ সুযোগে আমিনুলের স্ত্রী ও আনন্দসহ অচেনা ৩ জনের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যাচেষ্টাসহ উল্টো ৫ লাখ টাকা পাবে বলে মামলা ঠুকে দেন। ওই মামলায় আনন্দ বর্তমানে কারাগারে। সন্তানদের ফেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কিডনি রোগী আমিনুলের স্ত্রী। শারীরিক ও আর্থিক সমস্যায় বিপাকে আছেন আমিনুলও।

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর থানার এসআই মো. ফারুক আহমেদও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বলেন, তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলবেন তিনি।

চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার হিরনপুরের বাঘরা এলাকা থেকে কিডনি পাচারকারী চক্রের সদস্য নাজিম উদ্দীনকে (৩৮) গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। তিনি ঢাকায় একটি সোয়েটার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। জিজ্ঞাসাবাদে নাজিম বলেন, তিনি দীর্ঘদিন এলাকায় দরিদ্র ঋণগ্রস্ত মানুষদের কিডনি বিক্রিতে উৎসাহিত করে আসছিলেন। এভাবে নিজের স্ত্রীসহ অনেকের কিডনি ঢাকার আশরাফ নামে পাচার চক্রের এক সদস্যের মাধ্যমে বিক্রি করেছেন। নাজিম উদ্দিনের তথ্যও ইঙ্গিত দেয়- কিডনি পাচারচক্রের সদস্যরা ভালোভাবেই জেঁকে বসেছে রাজধানীতে।

কিডনি পাচার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত হাসপাতাল ও মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা প্রথমে খোঁজ নেন কোন কোন রোগীর কিডনির প্রয়োজন। খোঁজ পেলে কিডনির সন্ধানে পাচার চক্রের সদস্যরা প্রথমে গ্রামের দরিদ্র পরিবারকে টার্গেট করে। কর্মহীন অসহায় দরিদ্র নারী-পুরুষকে বিপুল অঙ্কের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে কিডনি বিক্রির প্রস্তাব দেয়। একই সময় তারা কিডনি বিক্রির জন্য নিজেদের উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে। চক্রের সদস্যরা নিজেদের সুস্থ শরীর দেখিয়ে জানায়, একটি কিডনি নিয়েও স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়। তবে তারা কখনই নিজেদের প্রতারিত হওয়ার গল্প প্রকাশ করেন না। ডোনারদের ঢাকার হাসপাতালে আনা-নেওয়া এবং অন্য ব্যয় বাদ দিয়ে কয়েক লাখ টাকা দিলে তারা সহজেই রাজি হয়ে যায়। চিকিৎসকরা মূলত প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করেন। তাদের পরামর্শেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেয় পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। অর্থের বিনিময়ে শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেচাকেনা অবৈধ হওয়ায় চক্রটি আগ্রহী দাতাদের সঙ্গে গ্রহীতাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে এমন ভুয়া প্রমাণপত্রের মাধ্যমে প্রতিস্থাপনের সময় হাসপাতালে কিডনি বিক্রি করে। রাজধানীতে কিডনি কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ৪২ জনের সন্ধান পাওয়া গেছে এ পর্যন্ত। তাদের অনেকেই বিভিন্ন অভিযানে গ্রেপ্তার হলেও বেশিরভাগই জামিনে আছেন যোগ করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com