আমেরিকার নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেনের রানিং মেট বা দলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে কমালা হ্যারিসের মনোনয়নের পর থেকেই অনলাইন উত্তাল হয়ে উঠেছে তাকে নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং ভুয়া দাবি ছড়ানোয়।
সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে যেসব তত্ত্ব ও দাবি, তার কয়েকটি খতিয়ে দেখেছে বিবিসি।
যোগ্যতা নিয়ে ভুয়া দাবি
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্মস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন যে তার জন্ম আমেরিকার বাইরে, তাই প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে ওবামা অযোগ্য – ঠিক একই রকম অভিযোগ তুলে ট্রাম্প বলেছেন হ্যারিসও ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালনের যোগ্য নন। ওবামাকে নিয়ে তার ওই বক্তব্য আমেরিকায় “বার্থার” বা “ওবামার জন্ম তত্ত্ব” হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। সেই দাবি পরে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়।
হ্যারিসের জন্ম আমেরিকায় ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের ওকল্যান্ডে। তার বাবা জ্যামাইকান এবং মা ভারতীয় বংশোদ্ভুত। কেউ আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করলে তিনি আমেরিকান নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হন, ফলে প্রেসিডেন্ট বা ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালনে তার কোন বাধা নেই।
কিন্তু গত সাত দিনে অনলাইনে “কমালা হ্যারিস বার্থার” এই শব্দগুলো ব্যবহার করে তার জন্ম নিয়ে কোন রহস্য আছে কি-না, তা খোঁজার হিড়িক পড়ে গেছে। গুগল ট্রেন্ডে অনেকে তার জন্ম স্থান কোথায়, সে নিয়ে খোঁজখবর শুরু করেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার এই সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলের জন্ম কোথায়, তা নিয়ে ২০১৭ সাল থেকে অনলাইনে মানুষ খোঁজখবর নিচ্ছে বলে জানাচ্ছে মিডিয়া ম্যাটারস্ ফর আমেরিকা নামে একটি মুক্তমনা মিডিয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থা।
তার জন্ম আমেরিকার বাইরে এমন দাবি সোশাল মিডিয়াতে আরও ছড়িয়েছে ‘কিউআনোন’ নামে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসী একটি গোষ্ঠী। এই মতাদর্শে বিশ্বাসীরা মনে করেন যে সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদ মাধ্যমের উপরতলায় যেসব শিশু যৌন নিপীড়নকারী রয়েছে, তাদের ব্যাপারে গোপনে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন ট্রাম্প।
মতাদর্শ ও পরিচয় নিয়ে ভুয়া দাবি
দাবি করা হয়েছে হ্যারিস ডানপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সাথে একাত্মতা দেখাতেন।
আরও অভিযোগ করা হয়েছে যে ভাইস-প্রেসিডেন্টের মনোনয়ন গ্রহণ করার আগে পর্যন্ত তিনি কখনও কৃষ্ণাঙ্গ বংশোদ্ভুত আমেরিকান হিসাবে নিজের পরিচয় তুলে ধরেননি।
বিবিসি দেখেছে এটা সঠিক নয় – কারণ হ্যারিস তার দ্বৈত বংশ পরিচয় সবসময় খোলাখুলিভাবে তুলে ধরেছেন।
তার আত্মজীবনীতে হ্যারিস লিখেছেন, “আমার মা সবসময় সচেতন ছিলেন যে তিনি দু’টি কৃষ্ণাঙ্গ কন্যাকে বড় করছেন।
“তিনি জানতেন, যে দেশকে তিনি এখন তার স্বদেশ বলে বেছে নিয়েছেন, সেই আমেরিকায় তাকে মায়া (তার বোন) আর আমাকে আত্মবিশ্বাসী ও গর্বিত নারী হিসাবে বড় করে তুলতে হবে। তিনি এই লক্ষ্য অর্জনে বদ্ধপরিকর ছিলেন।”
ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা লিখেছে, “হ্যারিস তার ভারতীয় সংস্কৃতিকে বুকে নিয়ে বড় হয়েছেন, কিন্তু নিজেকে একজন আফ্রিকান-আমেরিকান হিসাবে তুলে ধরে তিনি গর্ব বোধ করেন।”
একটি মিমের স্ক্রিন গ্র্যাব যেখানে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস বার্তা সংস্থার দুটি খবর পাশাপাশি রেখে দেখানো হয়েছে ২০১৬ এবং ২০২০য়ে সংস্থা তার পরিচয় লিখেছে দুরকম। বিবিসি বলছে এই মিমের কারণে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।
এই মিমটি ছড়ানো হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে, যেটি হ্যারিসের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।
ফেসবুক আর টুইটারে এই মিম কয়েক হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে, যেটি তৈরি করা হয়েছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) বার্তা সংস্থার দুটি খবর পাশাপাশি রেখে।
একটিতে রয়েছে তাদের ২০১৬র শিরোনাম, যেটিতে বলা হয়েছে মিস হ্যারিস প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভুত সিনেটর হয়েছেন। দ্বিতীয়টি এপির সাম্প্রতিক শিরোনাম, আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে তার নাম ঘোষণার পর।
এতে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে মিডিয়া হ্যারিসকে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান হিসাবে তুলে ধরতে শুরু করেছে জো বাইডেনের রানিং মেট হিসাবে তার নাম ঘোষণার পর থেকে। অথবা বলার চেষ্টা হয়েছে যে হ্যারিস এ পর্যন্ত নিজের ভারতীয় বংশ পরিচয়ের দিকটাই তুলে ধরেছেন এবং শুধু সেই পরিচয়েই পরিচিত হতে চেয়েছেন।
কিন্তু বিবিসি ইতোমধ্যেই হ্যারিসের আত্মজীবনীর যে উদ্ধৃতি দিয়েছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে তিনি তার কৃষ্ণাঙ্গ বংশ পরিচয় লুকানোর চেষ্টা করেননি।
এছাড়াও ২০১৬ সালে সিনেটে তাঁর নির্বাচনের ওই খবর সংক্রান্ত এপি বার্তা সংস্থার পুরো রিপোর্টে হ্যারিসকে ভারতীয় এবং আফ্রিকান বংশোদ্ভুত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মিস হ্যারিসকে লক্ষ্য করে আবার ‘পিৎসাগেট’ ষড়যন্ত্র
পরেরটি হল ভুয়া ‘পিৎসাগেট ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ নতুন করে ছড়ানো, যেখানে জড়ানো হয়েছে হ্যারিসের নাম।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় কয়েক হাজার লোককে বিনা সাক্ষ্যপ্রমাণে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এই অভিযোগে যে ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি পিৎসা রেস্তোরাঁর মাটির নিচের একটি ঘর থেকে হিলারি ক্লিনটন এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির উর্ধ্বতন কিছু সদস্য শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনকারীদের একটি চক্র পরিচালনা করছিলেন এবং তারা এর সাথে জড়িত।
আবার সামনে এসেছে সেই পুরনো অভিযোগ।
সোশাল মিডিয়াতে একটি ইমেল শেয়ার করে বলা হচ্ছে যে ওই ইমেলের মাধ্যমে কমালার বোন মায়াকে ক্লিনটনের সম্মানে একটি পিৎসা পার্টিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
কিউআনোন ষড়যন্ত্র গোষ্ঠীর ফেসবুক এবং টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এই গুজব ছড়ানো হচ্ছে এবং নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তাদের একটি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে এই মিথ্যা তথ্য কমালা হ্যারিস মনোনয়ন পাবার একদিন পর ফেসবুকে ছয় লাখের বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
এই ভুয়া ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থনে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। কিন্তু চরম ডানপন্থীরা ওই পিৎসা রেস্তোরাঁর ভুয়া পার্টির সাথে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম জড়িয়ে খবর ছড়ানো অব্যাহত রেখেছে।
আরেকটি মিম যেটাতে দেখা যাচ্ছে বারাক ওবামা জো বাইডেনের কানে কানে কিছু বলছেন। ছবির ওপরে টেক্সটে লেখা হয়েছে “সোরোস এইমাত্র ফোন করেছিলেন – আপনার ভাইসপ্রেসিডেন্ট প্রার্থী কামালা হ্যারিস” । বিবিসি এর সমর্থনে “কোন তথ্যপ্রমাণ পায়নি”।
হ্যারিসের সাথে জর্জ সোরোসকে জড়ানো
হ্যারিসের মনোনয়ন পাওয়ার সঙ্গে জড়ানো হয়েছে হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভুত জনহিতৈষী ধনকুবের জর্জ সোরোসকে – যেটি আরেকটি ভিত্তিহীন তত্ত্ব।
ফেসবুকে একটি মিম কয়েক হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে হ্যারিসকে মনোনয়ন দেবার নির্দেশ দিয়েছেন জর্জ সোরোস। বারাক ওবামা এবং জো বাইডেনের পুরনো একটি ছবির ওপর সে রকমই একটি বার্তা লিখে তা-ই বলার চেষ্টা হয়েছে।
সোরোস ডেমোক্রেটিক পার্টিতে প্রচুর চাঁদা দেন। কিন্তু তাই বলে ভাইস-প্রেসিডেন্ট মনোনয়নের ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার তাকে দেয়া হয়েছে, এমন কোন তথ্য প্রমাণ নেই।
তার ছেলে হ্যারিসকে টু্ইটারে অভিনন্দন জানিয়ে একটি বার্তা পোস্ট করেছেন। তার পোস্টটি ডানপন্থীরা ব্যাপকভাবে শেয়ার করেছেন। কিন্তু তারমানে এই নয় যে হ্যারিসের মনোনয়নের ব্যাপারে সোরোসের কোন হাত আছে। বিবিসি
Leave a Reply