1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
রবিবার, ০৩ অগাস্ট ২০২৫, ০২:১০ অপরাহ্ন

জুলাইয়ের গণ-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ কতদূর

‍ইউএস বাংলাদেশ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৫

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এক অনন্য ঘটনা। সেদিন রাজপথে ছিল ছাত্র, শ্রমিক, দোকানি, কেরানি, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, গৃহবধূ, কিশোর-কিশোরী, নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ। এত নারীর অংশগ্রহণ অতীতে কোনো সংগ্রামের মিছিলে দেখিনি। অতীতে কোনো মিছিলে হিজাব ও শার্ট-প্যান্ট পরা নারীরা এভাবে হাত ধরাধরি করে হাঁটেনি, কিশোরী কন্যা বা ছেলের হাত ধরে বাবা ও মা মিছিলে ছোটেননি। অতীতে কখনও কওমি মাদ্রাসার টুপি মাথায় লম্বা কোর্তা পরা শিক্ষার্থীর সঙ্গে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যান্ট-শার্ট পরা ছাত্রদের এমন সখ্য দেখা যায়নি। জুলাইয়ের রাজপথে বাঙালি, আদিবাসী, সব বর্ণ ও বিশ্বাসের মানুষ এক মিছিলে দাঁড়িয়েছিল। ডান-বাম- সব ধারার রাজনৈতিক নেতাকর্মী যুক্ত হয়েছিল। কী ছিল তাদের চাওয়া?

আন্দোলনের শুরুতে চাওয়া ছিল একটাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চেয়েছিল সরকারি চাকরিতে সাম্য, মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, যা শেখ হাসিনার শাসনামলে ছিল না। কোটাই ছিল মেধাভিত্তিক চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। তাই কোটার সংস্কারই ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি।

চাকরির বৈষম্য অবসানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে দাবি তুলেছিল, তা একসময় মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তকে স্পর্শ করল। তারা দেখল, দেশে যে ধনিক, অভিজাত গোষ্ঠী জন্ম নিয়েছে, তারা ক্রমেই ফুলে-ফেঁপে উঠছে। তারা এও দেখল, নব্য ধনী ও আমলা-মন্ত্রীদের সর্দি-কাশি হলে চেন্নাই, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর যায়। নিম্নআয়ের মানুষ ঢাকা মেডিক্যালেও চিকিৎসা পায় না। চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকল। তাতে ওপরতলার মানুষের মাথাব্যথা ছিল না, কিন্তু নিম্নবিত্ত এবং বিত্তহীনদের নাভিশ্বাস হয়ে উঠল। সামাজিক বৈষম্য ও চাকরিতে বৈষম্য একরেখায় মিলিত হলো। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ভোটের অধিকার, গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়া। তিনটি প্রহসনের নির্বাচনে ভোট না দেওয়ার যন্ত্রণা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল, তা উথলে ওঠে। তাই ভোটাধিকার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন একাকার হয়।

এ আন্দোলনকে খণ্ডিত করে দেখার সুযোগ নেই। শেষ বিচারে এটি আর নিছক কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছিল না, কেবল ভোটাধিকারের আন্দোলনও ছিল না। এটি ছিল সামগ্রিক পরিবর্তনের আন্দোলন।

১৯৭১ সালে জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন বুকে নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু অর্থনৈতিক-সামাজিক সাম্য আসেনি, স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসন-প্রশাসন গড়ে ওঠেনি। এমনকি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তনের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও এখানে অকার্যকর হয়ে পড়ে। অথচ গণদাবির মুখে পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ ও ১৯৭০ সালে দুটি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছিল।

স্বাধীন দেশে কোনো সরকারের আমলেই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। তাই রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের বিধান প্রবর্তন করেছিল। গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা সংবলিত তিন জোটের রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল। সেটি বাস্তবায়িত হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরও বিকশিত হতো। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ’৯০-এর সুফল নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু কোনো সরকারই তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন করেনি। সর্বশেষ অঘটন ঘটল শেখ হাসিনার হাতে। আদালতের দোহাই পেড়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করা হলো। এতে সুগম হলো শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পথ। তিনটি প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে হয়ে উঠলেন একনায়ক, বেপরোয়া ও দাম্ভিক। এই স্বৈরশাহির বিরুদ্ধে ১৫ বছর ধরে চলে আসা আন্দোলনের নেতাকর্মীও জুলাইয়ের আন্দোলনে মিলেছিল, গড়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য শক্তি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, জুলাই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছাত্ররা ছিল, তবে তা কেবল ছাত্রদের আন্দোলন ছিল না, কোনো একক দলের আন্দোলনও ছিল না। তা ছিল গণসংগ্রাম। এ গণসংগ্রামই গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিল। গণরোষের ভয়ে স্বৈরশাসক, দাম্ভিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন। এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের দেশ শাসনের ভার।

সরকারকে দেয়ালের লিখন পড়তে হবে। অভ্যুত্থান-উত্তর রাজপথের দেয়ালে গ্রাফিতির মাধ্যমে ফুটে উঠেছিল গণ-আকাক্সক্ষা। সরকার কি তা বিবেচনা করছে? রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রিক সংস্কারের সনদ তৈরির কাজ করছে। এটি জরুরি। এ জন্য সাধুবাদ জানাই। সেই সঙ্গে আমি ড. ইউনূস ও উপদেষ্টাদের দেয়ালের লিখন পড়ার আহ্বান জানাই।

ড. ইউনূসের কাছে একখানা গ্রাফিতির অ্যালবাম আছে, যার কপি তিনি অনেক বিশ^নেতাকে উপহার দিয়েছেন। এতে হয়তো সাক্ষী হয়ে আছে দেয়ালের সেই গ্রাফিতি, যেখানে একটি বৃক্ষ- শাখাগুলোয় লেখা আছে হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, আদিবাসী, নানা ধর্ম ও জাতিসত্তার পরিচয়। সেটিই জুলাইয়ের আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ, বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিরূপ। এটি পাঠ্যপুস্তকের প্রচ্ছদে ঠাঁই পেয়েছিল, উগ্রপন্থিদের হুমকিতে তা মুছে ফেলা হয়েছে।

যে নারীর পদভারে জুলাইয়ের রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছিল, সেই নারীই আজ নানা স্থানে লাঞ্ছিত হচ্ছে, তার পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বাউল ও বয়াতিদের ওপর হামলা হচ্ছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য মাজার। নানা স্থান থেকে ম্যুরাল ও ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে। শুরু হয়েছে সেই পুরনো খেলা। রংপুর গঙ্গাচড়ায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়।

কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলটি কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজের নামে নামকরণ করা হয়েছে। খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে জগদ্বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও কবি জীবনানন্দ দাশের নাম। আমি বুঝতে পারি না, এসবের পেছনে কারা? প্রশাসনে, নীতিনির্ধারণে কি একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা আছর করেছে, না সমাজদেহে নব্য উগ্রবাদের উত্থান ঘটেছে!

মব সহিংসতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সরকার তা দমনে ব্যর্থ। শুধু ব্যর্থই নয়, সরকারসংশ্লিষ্ট কেউ কেউ এটিকে মব ভায়োলেন্স মনে করেন না। তাদের বিবেচনায় এটি বিক্ষুব্ধ জনতা, প্রেশার গ্রুপ। এই মন্তব্য শোনার পর আমি হতবাক। আমরা কি স্বৈরতন্ত্রকে হটিয়ে মবতন্ত্র চেয়েছি? শেখ হাসিনার শাসনামলে ভয়ের সংস্কৃতি চালু ছিল, লিখতে বসলে আমাদের হাত কেঁপে উঠত- যা লিখতে চাইতাম, সব কথা লিখতে পারতাম না। যা বলতে চাইতাম, বলতে পারতাম না। এই ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যেও সাহস করে শক্ত হাতে কলম ধরেছি, স্বৈরশাসনের চরিত্র উদঘাটন করেছি, রাজপথের মিছিলেও যোগ দিয়েছি। ভেবেছিলাম, শেখ হাসিনার পতন হলে বাক, ব্যক্তি, কলম, তুলির স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। আজ মবতন্ত্র সত্য উচ্চারণে বড় হুমকি।

আমি বুঝতে পারি না- কোন পথে হাঁটছে বাংলাদেশ? জুলাইয়ের গণ-আকাঙ্ক্ষায় অন্তর্ভুক্তিমূলক বহুত্ববাদী সমাজ ও রাষ্ট্র, না মবতন্ত্রের হুমকিতে একরৈখিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র? আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একাত্তর, নব্বই ও চব্বিশের পথই বাংলাদেশের পথ- এ পথেই মুক্তি ও সমৃদ্ধি। একাত্তরের পরাজিত ও চব্বিশের পরিত্যক্ত শক্তি কোনো অঘটন ঘটাতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে পারে না, কখনও পারবে না।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com