যুক্তরাষ্ট্রে গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়ান তিনি। তার জায়গায় প্রার্থী হওয়া কমলা হ্যারিস শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে পাত্তাই পাননি, হারেন বড় ব্যবধানে। সেই নির্বাচনে বাইডেনকে হারানোর সুযোগ না পাওয়া ট্রাম্প এবার আরেক ক্ষেত্রে বাইডেনকে হারিয়ে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প নিজের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম পাঁচ মাসেই বাইডেন প্রশাসনের পুরো চার বছরের প্রায় সমপরিমাণ বিমান হামলা চালিয়েছেন।
টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়ে বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প সামরিক সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বরং বিভিন্ন দেশের যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা আরও তীব্র করেছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে গত জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পাঁচ মাসেই ট্রাম্প ইয়েমেন, সোমালিয়া, ইরাক, সিরিয়া এবং সর্বশেষ ইরানে বিমান হামলা চালিয়েছেন। এর মধ্যে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী ও সোমালিয়ার জিহাদিদের ওপর ট্রাম্পের আক্রমণ পূর্বসূরি বাইডেনের আমলে হওয়া হামলার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র ছিল।
বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রতিবাদের ঘটনা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা সংস্থা আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটার (এসিএলইডি) তথ্য অনুযায়ী, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ৫২৯টি বিমান হামলা চালিয়েছে, যেখানে পূর্ববর্তী প্রশাসনের পুরো চার বছরে এই সংখ্যা ছিল ৫৫৫টি। ট্রাম্পের আমলে হওয়া বিমান হামলার তীব্রতা তুলে ধরে এসিএলইডির প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক ক্লিওনাড রেলি বলেন, নতুন তথ্য প্রমাণ করে, ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ থেকে পিছু হটছে না। তিনি বলেন, ‘মাত্র পাঁচ মাসেই ট্রাম্প পূর্ববর্তী প্রশাসনের পুরো চার বছরের প্রায় সমপরিমাণ বিমান হামলা চালিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে, আরও কঠোর আঘাত হানছে এবং তুলনামূলকভাবে কম বাধা মানছে। সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন ও সোমালিয়ার পর সর্বশেষ ইরানেও আমরা সেটাই দেখতে পেয়েছি।’
এসব হামলার পক্ষে ট্রাম্পের যুক্তি হচ্ছে—তার এই তীব্র আক্রমণের পদ্ধতি ‘শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শান্তি’ নিশ্চিত করে।
দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ বিমান হামলার শিকার হয়েছে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা। এসিএলইডির তথ্য অনুযায়ী, লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলকে হুমকির মুখে ফেলা এই হুতি বিদ্রোহীদের ওপর জানুয়ারি থেকে ৪৭০টি বিমান হামলা হয়। তবে ১০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করে এমন তীব্র সামরিক হামলা চালিয়েও হুতি বিদ্রোহীদের পুরোপুরি দমন করতে পারেননি ট্রাম্প। গত সপ্তাহেও তারা লোহিত সাগরে দুটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়।
ট্রাম্প সোমালিয়াতেও হামলা বাড়িয়েছেন, যেখানে স্থানীয় ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী ও আল-শাবাবকে লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী। মার্চে হোয়াইট হাউস ঘোষণা করেছিল, তারা সোমালিয়ায় আইএসের একজন পরিকল্পনাকারীকে হত্যা করেছে। সে সময় ট্রাম্প উচ্ছ্বসিতভাবে বলেন, ‘আমাদের সামরিক বাহিনী বহু বছর ধরে এই পরিকল্পনাকারীকে লক্ষ্যবস্তু করেছিল; কিন্তু বাইডেন ও তার সহযোগীরা কাজটি সম্পন্ন করতে যথেষ্ট দ্রুত পদক্ষেপ নেননি। আমি করেছি। আইএস এবং অন্যদের প্রতি যারা আমেরিকানদের আক্রমণ করবে, তাদের প্রতি বার্তা হলো—আমরা তোমাদের খুঁজে বের করব এবং তোমাদের হত্যা করব।’
অধ্যাপক রেলি বলেন, ‘যদিও ট্রাম্প বারবার যুক্তরাষ্ট্রের ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধ’ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবে তিনি কীভাবে তা করবেন তার ব্যাখ্যা সেভাবে দেননি।’
এদিকে, গত জুনে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর হামলা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের সংঘাত চলার মধ্যেই ট্রাম্প ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনার ওপর হামলার নির্দেশ দেন। মূল হামলাটি ছিল ইরানের গোপন ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায়, যা মাটির গভীরে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমানের সাহায্যে এই স্থাপনায় ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ফেলা হয়, যে বোমা বিশেষভাবে ভূগর্ভস্থ স্থাপনা ধ্বংসে সক্ষম। ট্রাম্প দাবি করেন, ‘ইতিহাসের অন্যতম সফল এই সামরিক হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, যদিও পেন্টাগনের প্রাথমিক মূল্যায়নে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সীমিত ক্ষতির কথা বলা হয়।
এর আগে গত ১৩ মার্চ মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম) জানায়, তারা ইরাকের আল আনবার প্রদেশে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর অন্যতম নেতা আবদুল্লাহ মাক্কি মুসলিহ আল-রিফাইকে বিমান হামলায় হত্যা করেছে। আল-রিফাই, যিনি আবু খাদিজা নামেও পরিচিত ছিলেন, তাকে এই গোষ্ঠীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। সেন্টকম কমান্ডার জেনারেল মাইকেল কুরিলা সে সময় বলেন, ‘আবু খাদিজা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইএস সদস্যদের একজন ছিলেন। আমরা সন্ত্রাসীদের হত্যা এবং তাদের সংগঠনগুলোকে ভেঙে দেওয়া চালিয়ে যাব, যারা আমাদের মাতৃভূমি এবং এই অঞ্চল ও তার বাইরের মার্কিন, মিত্র ও অংশীদার কর্মীদের জন্য হুমকি তৈরি করবে।’
এ ছাড়া গত ১০ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর কমান্ডার রাখিম বোয়েভকে বিমান হামলায় হত্যা করার কথা জানায়। সে সময় তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, বোয়েভ সিরিয়ার বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ওপর হামলার পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন।
Leave a Reply