গত বছরের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে চলমান ছাত্র আন্দোলনের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি নিরাপত্তা বাহিনীকে ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহারের নির্দেশ দেন—এমন একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিংয়ের সত্যতা যাচাই করে তার প্রমাণ পেয়েছে বিবিসির অনুসন্ধানী ইউনিট বিবিসি আই ইনভেস্টিগেশন।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) বিবিসি এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে কীভাবে তারা অডিও রেকর্ডিংটির সত্যতা নিরূপণ করেছে।
কী আছে অডিওতে? গত মার্চ মাসে অনলাইনে প্রকাশিত হয় একটি ফোনালাপের অডিও, যেখানে শেখ হাসিনাকে একজন অজ্ঞাত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আন্দোলন দমনের বিষয়ে কথা বলতে শোনা যায়। এই অডিওটিই বিবিসির মতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ যে, শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের দমন করতে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, ওই সময়কার সহিংসতায় প্রাণ হারান অন্তত ১,৪০০ জন। এই ঘটনার জের ধরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচার চলছে, যেখানে ফাঁস হওয়া অডিওটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রসিকিউটররা।
বিবিসির যাচাই প্রক্রিয়া
বিবিসি জানায়, একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ওই ফোনালাপটি করেন।
বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) অডিওটির কণ্ঠস্বর শেখ হাসিনার সঙ্গে মিলে গেছে বলে জানায়।
এছাড়া অডিওটি প্রযুক্তিগতভাবে যাচাইয়ের জন্য বিবিসি ‘ইয়ারশট’ নামে অলাভজনক একটি সংগঠনের সহায়তা নেয়।
কী বলছে ইয়ারশট? ইয়ারশট জানায়, অডিও রেকর্ডিংয়ে কণ্ঠস্বর, ছন্দ, শ্বাস, স্বরধ্বনি এবং ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ বিশ্লেষণ করে তারা নিশ্চিত হয়েছে এটি সম্পাদিত নয়।
এতে ইলেকট্রিক নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি (ENF) চিহ্নিত হয়েছে, যা প্রমাণ করে রেকর্ডিংটি আসল এবং কোন রকম কাটাছেঁড়া হয়নি।
অডিওতে এমন স্বরযুক্ত টেলিফোনিক ফ্রিকোয়েন্সি ও ব্যাকগ্রাউন্ড শব্দ রয়েছে যা সাধারণত স্পিকার ফোনে কথোপকথনের সময় ধারণ করা রেকর্ডিংয়ে পাওয়া যায়।
তারা জানায়, অডিওটিতে কৃত্রিমভাবে তৈরি বা সম্পাদিত হওয়ার কোনো ইঙ্গিত মেলেনি।
প্রতিক্রিয়া কী? শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ এই অডিও রেকর্ডিং ও অভিযোগগুলো সরাসরি অস্বীকার করেছে।
আওয়ামী লীগের এক মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, “টেপ রেকর্ডিংটি সত্য কি-না, তা আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না।” তিনি আরও দাবি করেন, এটি শেখ হাসিনার বেআইনি কোনো উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটায় না।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনজীবী ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (ICT) পরামর্শক টবি ক্যাডম্যান বলেন, “এই রেকর্ডিংগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো স্পষ্ট, নির্ভরযোগ্য এবং অন্যান্য প্রমাণের সঙ্গে মিলে যায়।”
তিনি জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত ২০৩ জন অভিযুক্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৭৩ জন গ্রেপ্তার আছেন। পাশাপাশি আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের ভূমিকা নিয়েও বিচার চলছে।
এই তদন্ত ও অডিও যাচাই এখন শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
Leave a Reply