1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ০৫:৩৬ অপরাহ্ন

বাংলাদেশ কি দুই বিলিয়ন ডলারের বাজার হারাবে

অজেয় রোহিতাশ্ব আল কাযী
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫
স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ‘পাকিস্তানি’ উদ্যোক্তা বিতাড়ন। কেননা নতুন বাংলাদেশে ‘ফড়িয়া’ অনেক থাকলেও উদ্যোক্তা  কে খান ছাড়া তেমন কেউ ছিলেন না। ফলে যে বিশাল পাটশিল্প পাকিস্তানি উদ্যোক্তারা গড়ে তুলেছিলেন, তা পিতৃহীন ‘এতিম’ শিশুতে পরিণত হয়। আওয়ামী পান্ডাদের লুটপাটের জগতে পরিণত হয়, যা প্রাতিষ্ঠানিক করেন শেখ মুজিব জাতীয়করণের মাধ্যমে।

অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের ‘নিয়ন্ত্রণের কাঙ্ক্ষা’ থাকলেও পরিচালনের যোগ্যতা কখনোই ছিল না! মনোপলি বাজার ছাড়া আমলাতন্ত্রের পরিচালনায় কোনো ব্যবসাই লাভের মুখ দেখেনি  দেশে আজ পর্যন্ত। অত্যন্ত লাভজনক পাটশিল্পের পতনের শুরু সেই মুজিব আমল থেকেই, বড় জাহাজের যেমন ডুবতে সময় লাগে, পাটশিল্পের ক্ষেত্রেও হয়েছে তেমনটিই। বাংলাদেশ টেরটা পেয়েছে পরে

() পৃথিবীর মোট পাট উৎপাদনের বেশির ভাগই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। সর্বোপরি বাংলাদেশের পাটের আঁশের শক্তিপাটের রং পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বলেই বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট রপ্তানি হয় বিভিন্ন দেশে।

আজও বাৎসরিক যে ২০ লাখ টন পাট উৎপাদিত হয়, তার প্রায় ৯ লাখ টনই আমরা কাঁচামাল হিসেবে রপ্তানি করি বিভিন্ন দেশে।() গড়ে টনপ্রতি ৬৯০ ডলার মূল্যে কাঁচা পাট রপ্তানি হয় মূলত সড়কপথে। এই কাঁচা পাটই পাটজাত পণ্য হয়ে গড়ে এক হাজার ২০০ ডলার প্রতি টনে বিক্রি হয় বিশ্ববাজারে!

ঔপনিবেশিকতাবাদোত্তর কালে বাজার নিয়ন্ত্রণের এক নব্য ঔপনিবেশিকতার শিকার বাংলাদেশ, বদলেছে চামড়ার রং, মুখের ভাষা আর হরফ দেবনাগরী।

() বাংলাদেশের কি সক্ষমতা নেই এই রপ্তানি করা পাট প্রক্রিয়াজাত করার?

আদমজী-উত্তর বাংলাদেশের পাট কারখানাগুলো বছরে ১২ লাখ টন কাঁচা পাট প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা রাখে, কিন্তু সমস্যাটা বিপণনে।

সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে পাটজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারের যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করে মূলত ভারত। ফলে পাটপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার মূলত ভারতমুখী এবং ভারতীয় কিংবা ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিতযেখানে বাংলাদেশ ক্ষেত্রবিশেষ আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোর মতোই অনেকটা কাঁচামাল রপ্তানিকারক রাষ্ট্র মাত্রউপরন্তু ভারত বেশির ভাগ পাটজাত পণ্য আমদানিকারক রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে বসে আছেযেখানে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। ক্রেতারা সহজেই আকর্ষিত হয় ভারত থেকে পাটজাত পণ্য ক্রয়ে।তার ওপর নিজ শ্রমবাজার স্থিতিশীল রাখতে ভারত বাংলাদেশ থেকে পাটজাত পণ্য আমদানিতে টনপ্রতি

ন্যূনতম ১৩৯ ডলার, সর্বোচ্চ ৩৯৮ ডলার অ্যান্টিডাম্পিং ডিউটি আরোপ করে বসে আছে বাংলাদেশের ওপর। ফলে কাঁচা পাট ছাড়া কোনোভাবেই পাটজাত কোনো পণ্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি করা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়।

এই দুষ্টচক্র থেকে বেরোনোর উপায় কী? সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারিভাবে। অর্থাৎ পাট, কৃষি, শিল্পবাণিজ্যযুব ও ক্রীড়া, অর্থ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়গুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। কাঁচা পাট রপ্তানি আমরা নিষিদ্ধ করতে পারব না কোনোভাবেইযেমনটি করতে পারিনি ইলিশের ক্ষেত্রে।
পদক্ষেপ-১ : আমরা বরং কাঁচা পাট রপ্তানিতে টনপ্রতি ২৫০ ডলার ট্যাক্স বসাতে পারি এবং সড়কপথে সব কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ করে নৌবন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি হওয়া বাধ্যতামূলক করতে পারি। এই পদক্ষেপে প্রয়োজন অর্থবাণিজ্যপাট ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ।

পদক্ষেপ-২ : শস্যবিশেষত কফিকোকো, কাজু, আখরোটপেস্তা উৎপাদনকারী সব দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর পাটজাত পণ্যের বিশেষ রোড শো আয়োজন করা দরকারযেখান থেকে পণ্য উৎপাদক মিলগুলোর নাম, ঠিকানাফোন নম্বর, ইমেইল এবং উৎপাদিত পণ্যের তালিকা পুস্তিকাকারে অংশগ্রহণকারী আমদানিকারকদের দেওয়া হবে। এই আয়োজনের খরচ জোগাবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, কৃষি ও পাট মন্ত্রণালয় সম্মিলিতভাবে। এই দূতাবাসগুলো সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘দ্বিপক্ষীয় কৃষিজাত পণ্য কর মওকুফ বা হ্রাস’ চুক্তি সম্পাদন করে পাটজাত পণ্যের রপ্তানির পথ সুগমে ব্যবস্থা করতে পারে।

পদক্ষেপ-৩ : পাটের ওপর ধার্যকৃত টনপ্রতি ২৫০ ডলার ট্যাক্সযা সরকারের তহবিলে জমা হয়েছে তার অর্ধেক (১২৫ ডলার) ‘উৎপাদন প্রণোদনা’ হিসেবে অর্থবছর শেষে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রপ্তানি অনুযায়ী বণ্টন করা এবং বাকি ১২৫ ডলারের ৫০ ডলার দিয়ে পাট চাষিদের মধ্যে স্বল্পমূল্যে বীজবণ্টনের ব্যবস্থা করা হলে পাট উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, যা মনিটর করবেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।

পাট উৎপাদন বৃদ্ধি সাপেক্ষে সেরা তিনজন কৃষি কর্মকর্তাকে ‘বর্ষসেরা’ পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে, যার উল্লেখ তাঁর এসিআরে থাকবে।

পদক্ষেপ-৪ : পাট রপ্তানির ২৫০ ডলারের মধ্যে এখনো বাকি আছে টনপ্রতি ৭৫ ডলার, যা খরচ করা হবে কর্মী প্রশিক্ষণে। গোটা বাংলাদেশের সব কটি জেলায় যুব উন্নয়ন একাডেমি রয়েছে বিশাল জায়গা নিয়ে। চীনের যান্ত্রিক সহযোগিতা নিয়ে এই প্রতিটি সেন্টারকে পাটজাত পণ্য উৎপাদনের প্রশিক্ষণশালায় পরিণত করে স্বল্পশিক্ষিত, পিছিয়ে থাকা মানুষকে তিন মাসে প্রশিক্ষিত করে পাটশিল্পে নিয়োগ করা যায়।

কী লাভ হবে বাংলাদেশের? পাটশিল্পে (সুতা ও ব্যাগ) প্রতি টন পাট প্রক্রিয়াজাত করতে গড়ে ২৩ জন শ্রমিকের দরকার হয়।

বাংলাদেশে প্রতিবছর পাট উৎপাদিত হয় ২০ লাখ টন, অর্থাৎ উৎপাদিত পাট প্রক্রিয়াজাত করতে গেলে শুধু শ্রমিকই লাগবে ৪৬ লাখ! তদারককারী, কর্মকর্তাসহ কর্মসংস্থান হবে প্রায় ৫৫ লাখ মানুষের। উপরন্তু গড়ে টনপ্রতি এক হাজার ২০০ ডলার মূল্য ধরলে বাংলাদেশের উপার্জন হবে বছরে ২৪০ কোটি ডলার। উপার্জিত এই বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই বাংলাদেশের, ব্যাক টু ব্যাক এলসির মূল্য পরিশোধের দায় নেই।

যেই মুহূর্তে কাঁচা পাট রপ্তানিতে ২৫০ ডলার শুল্ক বসানো হবে এবং সমুদ্রবন্দর দিয়েই শুধু কাঁচা পাট রপ্তানি করা বাধ্যতামূলক করা হবেসেই মুহূর্ত থেকেই বিশ্ববাজারে পাটজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। অবশ্যম্ভাবীরূপেই। ফলে বিশ্বের পাটপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণের কিছুটা ফিরে পাবে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে কোকো, কফি, কাজু, আখরোটপেস্তা উৎপাদনকারী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যদি বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি শুল্ক হ্রাসের চুক্তিটি করতে সক্ষম হয়, বিশ্ববাজার খুলে যাবে পাটপণ্য উৎপাদকদের জন্য।

সেই সঙ্গে উৎপাদন প্রণোদনা, পাট-কৃষকের প্রণোদনাসেরা কৃষি কর্মকর্তার প্রতিযোগিতা পাট চাষ বৃদ্ধি এবং পাটপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। বাজার তো তৈরিই আছে!

বর্তমানের কর্মীসংকট মোকাবেলায় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর তৈরি রেখেছে প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী। অন্যদিকে সৌদি আরবও তৈরি ১০ বছর ধরেই এই পাটপণ্য উৎপাদন খাতে বিপুল বিনিয়োগে, যা বিগত সরকার স্থগিত রেখেছে। এই সব পদক্ষেপ এক করলে বিশ্বের পাটপণ্যের বাজার সম্পূর্ণভাবেই বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আর কে না জানে, বাজার নিয়ন্ত্রণকারী দেশ সর্বোচ্চ সুবিধা এবং মূল্য বরাবরই আদায় করে নেয়।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি খাত হিসেবে বাংলাদেশ কি পারবে পাটকে প্রণিধানযোগ্য করতে, নাকি আর সব কিছুর মতোই এই দুই বিলিয়ন ডলারের বাজারও হারাবে বাংলাদেশ?

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com