বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে সংকট বিরাজ করছে, তা জনগণ তৈরি করেনি। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর আন্দোলনরত তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী দেশে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাকেন্দ্রিক তত্পরতার কারণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ১৯৯৪ সাল থেকে এই সংকট গভীরতর হয়। গণতন্ত্র বিঘ্নিত হয়। সেই সময় থেকে বিদেশি অনেক শালিসকারকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য তত্পরতা চালাতে দেখেছি। কিন্তু কোনো সমঝোতা প্রচেষ্টাই সফল হয়নি। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ এবং আরো কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শালিসকারগণ বাংলাদেশে এসেছিলেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার প্রচেষ্টা এ দেশের মানুষ দেখেছে। রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এ দেশের মানুষ ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছে। সেই সময় ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়েছিল।
জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক বিধিবিধানের মধ্য দিয়ে দেশকে সত্যিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করানো। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে পছন্দনীয় সরকার গঠন করতে পারবে, এটাই সবার প্রত্যাশা এবং মূল আকাঙ্ক্ষা। এখানে কোনো ধরনের ছলচাতুরীর সুযোগ নেই। সাম্প্রতিক গণআন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটাসুবিধা সংস্কার প্রশ্নে। পরবর্তীকালে তা সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। আন্দোলনের মূল উপজীব্য ছিল গণতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্র।
কোনো কোনো মহল থেকে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিতকরণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পাঁচ বছরের ক্ষমতায় রাখা, জাতীয় সরকার গঠন ইত্যাদি যেসব ইস্যু উত্থাপন করা হচ্ছে। এগুলো আসলে দেশকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটি প্রচেষ্টা মাত্র। এভাবে কখনোই রাজনৈতিক সংকট সমাধান করা যাবে না। সম্ভব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে এত ছলচাতুরী, কলাকৌশল করার কিছু নেই। এতে বরং সংকট আরো ঘনীভূত হবে। এসব কূটচাল দিয়ে কোনো কাজ হবে না। বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল দায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ফিরে যাওয়া। এই মুহূর্তে নির্বাচিত সরকার আসা খুবই প্রয়োজন। কারণ একটি নিয়মিত সরকার ছাড়া বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ এসব বিষয় অনেকটাই নির্ভর করছে নির্বাচিত সরকারের ওপর। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিয়মের ধারাবাহিকতা দেখতে চায়। নির্বাচিত সরকার ছাড়া নিয়মের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব নয়। দেশে মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি-দখলদারিত্ব হচ্ছে। চাঁদাবাজদের পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। পলিটিক্যাল এজেন্ডাতে ‘মব কালচার’ হচ্ছে। কোনো কোনো স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুর্বৃত্তরা নানা প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সামাজিক অপরাধীরা এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি তত্পর রয়েছে। ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু তার পরও পরিস্থিতির আশাব্যঞ্জক উন্নতি হচ্ছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। অনেকেই এমনও অভিযোগ করছেন যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে সন্ত্রস্ত অবস্থা বজায় রাখতে চায়। সরকারের প্রণোদনায় ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি গঠিত হয়েছে। অস্থিতিশীল অবস্থা বজায় থাকলে সেই সুযোগে নবগঠিত এই রাজনৈতিক দলকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি বা অন্যান্য বড় দল থেকে কর্মী ভাগিয়ে এনে নবগঠিত এই দলে যুক্ত করা যাবে। অতীতে আমরা এই প্রবণতা প্রত্যক্ষ করেছি। ক্ষমতায় বসে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করা হলে বিভিন্ন দল থেকে সুবিধাবাদীদের ভাগিয়ে এনে সেই দলে যুক্ত করা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন কোনো উদ্দেশ্য আছে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রমাণ করতে হবে, তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। যদি সে ধরনের কিছু হয়, তাহলে গণআন্দোলনের মাধ্যমে যে প্রত্যাশা বা আকাঙ্ক্ষা গড়ে উঠেছে, তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
দেশের মানুষ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এটাই প্রত্যাশা করে। গণতন্ত্রের প্রত্যাশা মানুষের তাত্ক্ষণিক চাওয়া নয়। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই তারা জনগণের অংশগ্রহণে সত্যিকার উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রত্যশা করে আসছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সেই প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি। গণপ্রত্যাশা পূরণ করতে হলে জাতীয় সরকার বা বিকল্প কোনো সরকারের মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। এজন্য জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকার গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে সংকট প্রত্যক্ষ করছি, তা সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো জনপ্রত্যাশাকে পদদলিত করে নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টার কারণেই। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ মূলত দুটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটাধিকারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্যটি অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের ৫৪ বছর পরও এই দুটি উদ্দেশ্য অর্জিত হয়নি। আমরা এখনো গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের জন্য আন্দোলন করছি। বর্তমানে দেশে সম্পদ বৈষম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশের মোট সম্পদের বেশির ভাগই ওপরের পর্যায়ের ৫ শতাংশ মানুষের কুক্ষিগত হয়েছে। অবশিষ্ট ৯৫ শতাংশ মানুষ বঞ্চনার শিকারের পরিণত হয়েছে। তারা ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পদের ভাগ পাচ্ছে না। বিত্তবান-বিত্তহীনের মধ্যে সৃষ্ট ব্যবধান ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ছাত্ররা আন্দোলনের সময় সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটা সুবিধা সংস্কারের দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু বৈষম্য তো শুধু এই এক ক্ষেত্রে নয়। বৈষম্য তো সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান রয়েছে। এসব বৈষম্যও দূরীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। সব ক্ষেত্রে মানুষের যৌক্তিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা না গেলে কোনো লাভ হবে না। কারণ মূল বৈষম্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান রয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ করতে হলে সত্যিকার উদার গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই সরকার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিদ্যমান বৈষম্যগুলো দূরীকরণের চেষ্টা চালাবে।
আমরা সংস্কারের বিরুদ্ধে নই। সংস্কার হচ্ছে একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কার প্রক্রিয়া কখনোই শেষ হবে না। নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরও সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল দায়িত্ব হচ্ছে, এমন কিছু জরুরি সংস্কার সাধন করা, যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য হতে পারে। অবশিষ্ট সংস্কার কার্যক্রমের সূচনা করা যেতে পারে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা সেই সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সংস্কারের অজুহাতে কোনোভাবেই নির্বাচন বিলম্বিত করা উচিত হবে না। এটা করা হলে দেশ আরো গভীর সংকটে পতিত হতে পারে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ বছর ডিসেম্বর অথবা আগামী বছর জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। যদি স্বল্প সংস্কারের পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে তা এ বছর ডিসেম্বর মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। আর সংস্কার যদি বৃহত্ আকারে করা হয়, তাহলে নির্বাচন আগামী বছর জুন মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল দায়িত্ব যেহেতু নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা, তাই অচিরেই নির্বাচনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নির্বাচন কত তারিখে অনুষ্ঠিত হবে, তার সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে হবে। নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা ঠিক নয়, কাম্যও নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে দিতে পারে তাহলেই দেশ নৈরাজ্যমুক্ত হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। এই বাস্তবতা সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। নিয়মিত সরকার ছাড়া দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যাবে না। দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে নানা ধরনের তত্পরতা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এই তত্পরতা নির্বাচিত সরকার ছাড়া সঠিকভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। কারণ অন্তর্বর্তীকালীন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার নয়। নানা ধরনের গুজব শোনা যাচ্ছে। আন্দোলনের সমন্বয়কদের কেউ কেউ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করছে। দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য ভেতরে বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এসব মোকাবিলা করার জন্য নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই।
৫ আগস্টের পর কোনো কোনো রাজনীতিক ক্ষমতায় না গিয়েও ক্ষমতা উপভোগ করছে। তারা বিভিন্ন স্থানে নিয়োগ-বদলির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে। থানা থেকে আসামি ছিনিয়ে নিচ্ছে। আগে একদল চাঁদাবাজি করত। এখন আর একদল চাঁদাবাজি করছে। এটা তো চলতে পারে না। রাজনৈতিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত এটা চলতেই থাকবে। দ্রুত নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ না করলে এই অবস্থা চলতেই থাকবে।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটি
অনুলিখন: এম এ খালেক
Leave a Reply