খেলার মাঠ কমে যাওয়া ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে যে সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে তা হলো ভিডিও গেমের নেশা। শিশুরা কম্পিউটারে বা প্লে স্টেশনে গেম খেলতে পছন্দ করে। বড়রাও তাদের আদর করে গেমের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে দেন। গেমের মাধ্যমে শিশুরা অনেক কিছু শিখতেও পারে আবার এই গেম যদি আসক্তির পর্যায়ে পড়ে তখন শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও লেখাপড়ার দিক থেকে ক্ষতিও হয়। অভিভাবকদের লক্ষ্য রাখতে হবে শিশুর গেমটি যেন নেশার পর্যায়ে না পড়ে।
কী করে বুঝবেন
নিচের প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন আপনার শিশু গেমের নেশায় আক্রান্ত কি না। শিশুটি কি লম্বা সময়ের জন্য গেম খেলে?
শিশুটি কি সময় মেনে গেম খেলতে ব্যর্থ হয়?
গেম খেলার জন্য নির্ধারিত সময় শেষে উঠে পড়তে বাধ্য হলে অস্থির হয়ে যায়?
শিশুটি কি অন্যান্য কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে (যেমন : সামাজিক যোগাযোগ, কারও বাসায় বেড়াতে যাওয়া বা বাইরের খেলাধুলা)?
শিশুটির পরীক্ষার ফল খারাপ হচ্ছে?
স্কুল থেকে দেওয়া বাড়ির কাজ সে কি খেলার জন্য করছে না?
ঠিকমতো স্কুল করছে না?
শিশুটি কি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে দূরে থাকছে (গেম খেলার কারণে)?
বন্ধু গ্রুপে কম মিশছে বা শুধু যারা গেম খেলছে তাদের সঙ্গে মিশছে?
সে কি পারিবারিক নিয়ম ভঙ্গ করছে, যাতে সে আরও বেশি সময় ধরে গেম খেলতে পারে (যেমন : রাত্রে ঘুম থেকে উঠে গেম খেলছে বা গেম বেশি খেলার জন্য মিথ্যা বলছে)?
খাবার কম খাচ্ছে, গেমের সামনে বসেই খাচ্ছে, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতায় অবহেলা, ঠিকমতো ঘুমাচ্ছে না?
গেম খেলতে নিষেধ করলে বা গেমের সময় কমানোর কথা বললে আক্রমণাত্মক আচরণ করে?
প্রতিরোধে কী করণীয় : সব গেম শিশু-কিশোরদের জন্য নয়। তাই শিশুদের কম্পিউটার ও গেম দেওয়ার সময়ে লক্ষ্য রাখুন যেন বয়স উপযোগী হয়। কোনো কোনো গেমে বয়স অনুযায়ী মুড সেট করা যায় সেটিও করে নিতে পারেন। গেম দেওয়ার শুরুতেই চুক্তি করে নিন যে সে প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে কতটা সময় ধরে গেম খেলতে পারবে। দিনের কোন সময়ে খেলবে। বেশি খেললে বাবা-মায়ের দায়িত্ব কী হবে তাও আলোচনা করুন।
পর্যবেক্ষণ করুন : অনেক বাবা-মা আছেন যারা গেম খেলতে দেখলেই অস্থির হয়ে যায়। শিশু-কিশোররা কিছুটা গেম খেলতেই পারে। প্রথমেই অস্থির হয়ে যাবেন না। শিশুর গেম খেলার ধরন, কতক্ষণ ধরে খেলছে, প্রতি ২৪ ঘণ্টায় গড়ে কতক্ষণ গেম খেলছে, গেম খেলার ফলে তার কী ক্ষতি হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করুন।
আলোচনা করুন : পর্যবেক্ষণ করার পর শিশুর সঙ্গে আলোচনা করুন। প্রশ্ন করুন সে কতক্ষণ ধরে গেম খেলে, তার কী কী শারীরিক সমস্যা হচ্ছে, পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে কি না ইত্যাদি। সমস্যাগুলো এমন থাকলে ভবিষ্যৎ জীবনটা কেমন হতে পারে ভাবতে সাহায্য করুন।
পিসি বা গেম যন্ত্রে সতর্ক সংকেত লিখে রাখতে বলুন : কম্পিউটার বা প্লে স্টেশনের গায়ে সকর্তকতা সংকেত লিখে রাখা যেতে পারে। যেমন : একটি ছাত্র তার কম্পিউটারের গায়ে ও গেমের ফোল্ডারে লিখে রেখেছিল ‘উড় ুড়ঁ ধিহঃ ঃড় ঢ়ধংং’। এর ফলে সে যতবার গেম খেলতে যেত ততবার লেখাটি দেখে ফেল করার ভয়ে পরীক্ষার মধ্যে আর গেম খেলেনি।
সেল্ফ মনিটরিং ডায়েরি
অনেক সময় শিশুরা প্রশ্ন করলেই সচেতন হয়ে যায় আবার অনেক সময়ে বুঝতে পারে না যে, এতটা সময় নষ্ট হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিশু-কিশোরটিকে বিভিন্ন ধরনের সেল্ফ মনিটরিং ডায়েরি দেওয়া যেতে পারে।
এই ডায়েরিটিতে সকালে ঘুম থেকে ওঠা শুরু করে প্রতিটি সময়ে কীভাবে কাটছে তা লিখবে। যেমন : আজ সোমবার সকাল ৯-১০টা এই সময়ে সংবাদপত্র পড়লে সোমবারের ৯-১০টার ঘরে ‘সংবাদপত্র’ লিখতে হবে। শিশু-কিশোরটি তার দিন কীভাবে কাটছে তা টের পাবে। প্রতিটি দিন শেষে মোট কত ঘণ্টা গেম খেলা ও কত ঘণ্টা পড়া শোনা হলো নিচে লিখতে বলতে হবে। তার কাছে প্রকৃত সত্যটি অনুভূত হবে।
কখন ও কীভাবে গেম বন্ধ করতে হবে : কখনো কখনো এমন হয়ে যায় যে, শিশু-কিশোরটি সবসময়ই গেম খেলছে। তার সঙ্গে কথা বলা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে গেম বন্ধ করে দেবেন না। এতে তার মধ্যে আক্রমণাত্মক মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে। চলন্ত গেমের মধ্যে কথা বলবেন না। এ সময় সে আপনার কথার দিকে মনোযোগ ও গুরুত্ব দিতে পারবে না। তার সঙ্গে কথা বলতে হলে তার গেমের একটি পর্যায় বা মিশন শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করুন বা গেমটি থামাতে (চধঁংব) বলে তার সঙ্গে কথা বলুন। জিজ্ঞাসা করুন সে কতক্ষণ ধরে গেম খেলছে? কতক্ষণ খেলতে চায়? ঠিক কটার সময়ে গেম বন্ধ করবে? ধরুন সে বলল, ‘আমি ১১:৩০-এ গেম বন্ধ করব’। ১১:২০-এ তাকে একটি সতর্ক সংকেত দিন এবং দু-এক মিনিট আগে একটি সতর্ক সংকেত দিন। ঠিক ১১:৩০-এ গেম বন্ধ করতে বলুন।
পুরস্কার হিসেবে গেমের ব্যবহার : নির্দিষ্ট পরিমাণ পড়াশোনা বা বাড়ির কাজ করলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বা বাড়তি সময়ের জন্য গেম খেলার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এভাবে গেমের আকর্ষণটি পড়াশোনার আকর্ষণে পরিণত করা যেতে পারে।
সাইকোথেরাপি: ওপরের কৌশলগুলো প্রয়োগ করেও যদি শিশুর গেমের নেশা থেকেই যায় তবে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে সাইকোথেরাপি করানো যেতে পারে।
Leave a Reply