1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৩:১০ অপরাহ্ন

জুলাই অভ্যুত্থানের পরোক্ষ এক অনুঘটকের কথা

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতা এক হয়ে কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করেন। এ প্রতিবাদী আন্দোলনটি প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে শুরু হয়। সরকারি গড়িমসির কারণে পরবর্তী সময়ে এটি এক দফার সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন এ দেশের অকুতোভয় ছাত্রসমাজ। ছাত্রসমাজই এ দেশে যুগে যুগে বিভিন্ন শাসনামলে জাতীয় সংকটকালে জনগণের স্বার্থরক্ষায় কাজ করেছে। জনগণের অধিকার আদায়ে জীবন দিয়েছে। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায়, শিক্ষার অধিকার আদায়ে এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকায় ওই আন্দোলনগুলো সফল হয়েছে। লক্ষণীয়, উল্লিখিত প্রতিটি আন্দোলনে সামনের সারিতে অবস্থান করে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-জনতা রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় জায়গা পেয়েছেন। তবে এসব আন্দোলনে পর্দার অন্তরালে থেকে সমর্থন জুগিয়ে আন্দোলন বেগবান করে আন্দোলনকে সফল করতে প্রাণশক্তি জোগানো ব্যক্তিত্বরা পর্দার অন্তরালে রয়ে গেছেন। তারা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাননি। উল্লেখ্য, এসব মহান দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব কখনোই তাদের ভূমিকার মূল্যায়ন বা স্বীকৃতির জন্য কাজ করেননি। ইতিহাসের পাতায় স্থান না পেলেও এরা গভীর শ্রদ্ধার আসন পেয়েছেন জনগণের হৃদয়ে।

২০২৪-এর জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে আমরা একই চিত্র প্রত্যক্ষ করি। এ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তী সরকার আমলে নতুনভাবে আলোকিত হয়েছেন। তাদের দুজনকে সরকারের উপদেষ্টা করা হয়েছে। বাকিরাও সমাজে সম্মানিত হয়েছেন। এরা পরে দল গড়েছেন। হয়তো রাজনৈতিক ময়দানেও ক্রমান্বয়ে জায়গা করে নেবেন। তবে আন্দোলনকালে যারা এদেরকে বিভিন্নভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন, তারা হয়তো পর্দার অন্তরালেই থেকে যাবেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলগুলোর মতো একই ভঙ্গিমায় চট্টগ্রামে জুলাই আন্দোলনের চূড়ান্ত অবস্থায় যখন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও অন্য সরকারদলীয় অঙ্গ সংগঠনগুলো পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের নির্মমভাবে মারধর করছিল, তেমন সময় আন্দোলনকারীদের সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছিলেন সাধারণ জনতা। এ প্রবন্ধে এমন একটি ঘটনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হবে।

৪ আগস্ট, চট্টগ্রাম এনায়েতবাজার, লাভ লেইন, কাজির দেউড়ি, লালখান বাজারসহ শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যখন নিউমার্কেট মোড়ে সমাবেশ করার জন্য জড়ো হচ্ছিলেন, পুলিশ তখন তাদের ওপর নির্মমভাবে আক্রমণ করে। কাঁদানে গ্যাস এবং গুলিবর্ষণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে আহুত সমাবেশ পণ্ড করে দেয়। এমতাবস্থায় ছাত্রলীগসহ সরকারদলীয় অন্য সংগঠনগুলো আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পাশবিকভাবে আক্রমণ চালালে ছাত্ররা বিপর্যস্ত হয়ে দিগবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। এনায়েতবাজারে এমন ধাওয়া খাওয়া একদল আন্দোলনকারী ছাত্রদের দুপাশ থেকে সশস্ত্র ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা যখন আটকে ফেলে, তখন বিপন্ন অবস্থায় জীবন বাঁচাতে শিক্ষার্থীরা অলিগলিতে ঢুকে পড়েন। বিভিন্ন অপরিচিত ঘরবাড়িতে ঢুকে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করেন।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব আন্দোলনকারীর অনেককে গলি রাস্তার মধ্য থেকে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা ধরে এনে নির্মমভাবে কুপিয়ে জখম করেন। এদের অত্যাচারে কেউ কেউ আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আবার অনেকে সাধারণ মানুষের বাসাবাড়িতে ঢুকে জীবন বাঁচাতে আত্মগোপন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম শুভ তাদের একজন। উল্লেখ্য, আন্দোলন চলাকালে তিনি ১৬ জুলাই তারিখে মুরাদপুর এলাকায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের রডের আঘাতে বাঁ হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আহত হন। আহত অবস্থায়ও প্রতিদিন তিনি আন্দোলন কর্মসূচিতে যোগ দিতে থাকেন। এভাবে ৪ আগস্ট তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উল্লেখিত চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের সমাবেশে যোগ দেন। ওইদিন নিউমার্কেট সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর পুলিশ ও ছাত্র-যুবলীগের ধাওয়া খেয়ে আন্দোলনকারী কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী এনায়েতবাজারে ইসলামিক ব্যাংক বহুতল ভবনে ঢুকে অবস্থান নিলে সেখানেও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা চলে আসে। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রাণভয়ে ওই বিল্ডিংয়ের ওপরে উঠতে থাকেন। এমন দুঃসময়ে একটি ফ্ল্যাটে এক মমতাময়ী মা তাদের কয়েকজনকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে লুকিয়ে থাকার সুযোগ করে দেন। বাড়ির ছেলেগুলোও পরিচয় না জানা সত্ত্বেও তাদের প্রাণ বাঁচাতে সহায়তা করেন। বাড়ির দরদি বৌমা রান্না করে লুকিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের যত্নের সঙ্গে খাওয়ান। নামাজ ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন। পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে বেশ কয়েক ঘণ্টা পর সন্ধ্যার প্রাক্কালে বাড়ির ছোট ছেলে কাফি আশ্রয়ে থাকা জাহিদুল ইসলামকে এনায়েতবাজার থেকে নিজ পকেটের টাকা খরচ করে রিকশায় তার গন্তব্য ষোলশহর দুই নম্বর গেট মসজিদ গলির মুখে পৌঁছে দেন। ফলে এ আন্দোলনকারী ছাত্রের জীবন বেঁচে যায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের এ ছাত্র যখন প্রবন্ধকারকে এ ঘটনার বর্ণনা দেন, তখন তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তার চোখ সজল হয়ে ওঠে। তিনি বার বার কম্পিতকণ্ঠে বলছিলেন, স্যার, এ পরিবারটি যদি আমাদের লুকিয়ে থাকার সুযোগ না দিত, তাহলে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে আমাকে হয়তো ওইদিন জীবন দিতে হতো। স্যার, আমরা যারা ৬-৭ জন ওই বিল্ডিংয়ে এবং এর আশপাশে লুকিয়ে ছিলাম, তাদের মধ্য থেকে ফিরে যাওয়ার সময় একজন পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া যে, আমাকে যে মা লুকিয়ে রেখেছিলেন, তারই ছেলে ঝুঁকি নিয়ে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমি জিজ্ঞাস করলাম, বাবাজি আপনি কি সেই বাসাটি চিনবেন? ছাত্র বললেন, স্যার আমি চিনতে পারব। প্রমাণ হিসাবে তিনি ওই গৃহকর্ত্রীর ফোন নম্বর তার কাছে আছে বলে জানালেন এবং ওই বাসায় থাকাকালীন ওই পরিবারের সঙ্গে তোলা একটি ছবিও আমাকে মোবাইলে দেখালেন। এ ঘটনা জেনে আমি আবেগাপ্লুত হই। এমন ঘটনা জানার পর আমি শিক্ষক ও উপাচার্য হিসাবে বসে থাকতে পারি না। কারণ, জুলাই গণ-আন্দোলনে সমগ্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিহতদের দুজন ছাত্রই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এদের তো আমরা বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু আমাদের অন্য অনেক শিক্ষার্থীকে যারা সংকটকালে বাঁচিয়েছেন, তাদের প্রতি আমরা অশেষ কৃতজ্ঞ। সেজন্য এ ঘটনা জানানোর পর আমি ওই সাহসী মাকে আমাদের ছাত্র বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।

আমি ছাত্রকে বলি, বাবা আপনি যে ছবিটি ওই পরিবারের সঙ্গে তুলেছিলে, সে ছবিটি কি বড় করা সম্ভব? তিনি বললেন, হ্যাঁ স্যার সম্ভব, কিন্তু কেন? আমি বললাম, বাবা, আমি খরচ দিচ্ছি আপনি ওই ছবিটি বড় করে ভালো ফ্রেমে বাঁধাই করে নিয়ে আসবেন। আমরা ওই ছবিটি এবং ফুল ও মিষ্টি নিয়ে ওই মাকে দেখতে যাব। তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সারপ্রাইজ গিফট হিসাবে ছবিটি দিলে হয়তো তিনি খুশি হবেন। ছাত্র আমার পরিকল্পনা শুনে খুশি হলেন এবং যথারীতি ছবিটি বড় করে চকবাজার থেকে ফ্রেমে বাঁধাই করে আনলেন। পরে আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের পরিচালক এবং তার স্ত্রী কন্যাসহ লাভ লেইনের ওই বাসায় যাই। ওখানে গিয়ে বুঝলাম, তারা ওখানকার বনেদি পরিবার এবং স্থানীয় বাসিন্দা। সবাই তাদের চেনেন এবং ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। আমাদের সানন্দে গ্রহণ করা হলো। আমি ওই বাসায় আসরের নামাজ আদায় করলাম। কৃতজ্ঞতা জানানোর সময় বললাম : আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দুজন ছাত্র শহিদ হয়েছেন। ফরহাদ হোসেন আর হৃদয় তরুয়াকে আমরা আর কখনো ফিরে পাব না। ওই দুই কৃতী শিক্ষার্থীর মতো আমাদের আরও অনেক শিক্ষার্থী নিহত হতেন যদি ঘরে ঘরে আপনার মতো মা না থাকতেন। অনেক মা, বাবা, ভাই, বোন, আমাদের অনেক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের চরম বিপদের সময় নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আশ্রয় দিয়ে বাঁচিয়েছেন। আমরা তাদের সবার কাছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা কে কোথায় কীভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, আমরা বলতে পারব না। আমরা তাদের অনেকেরই ঠিকানা জানি না। তাদের সবাইকে চিনিও না। তবে তাদের এ সমর্থন ও আত্মত্যাগ আমরা কোনোদিন ভুলব না। আমাদের ৩০ হাজার শিক্ষার্থীও তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। যেহেতু আপনাকে আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি, সে কারণে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি। আমরা আপনার জন্য কিছু ফুল আর স্মৃতির নিদর্শন হিসাবে আপনাকে দেওয়ার জন্য একটি ছবি নিয়ে এসেছি।

দেশপ্রেমিক এই মা আমাদের হাত থেকে এমন অপ্রত্যাশিত নিজের ছবি সংবলিত উপহার পেয়ে খুশি হলেন। এভাবে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে পেরে আমাদের খুব ভালো লাগে। আমি নিশ্চিত, উপহার হিসাবে পাওয়া ছবিটি ওই পরিবার জুলাই আন্দোলনে তাদের পরিবারের অপ্রকাশ্য অংশগ্রহণের প্রমাণস্বরূপ সযত্নে সংরক্ষণ করবেন। এমন আবেগঘন সময়ের মধ্যেই চট্টগ্রামের মেহমানদারির ঐতিহ্য অনুযায়ী আমাদের আপ্যায়নের জন্য অনেক রকম খাবারের আয়োজন করা হয়। অগত্যা আমাদের কিছু খেতে হয়। এ রকম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হয়তো হাজারও পরিবার, বা মা-বাবা, যারা আমাদের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচিয়েছেন, বা তাদের সমর্থন দিয়েছেন, তাদেরকে হয়তো এভাবে আমরা শনাক্ত বা সম্মানিত করতে পারিনি। তবুও এদের একজনকে হলেও কৃতজ্ঞতা জানাতে পেরে আমরা স্বস্তিবোধ করেছি। আমি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একজন অভিভাবক ও সমর্থনকারী হিসাবে এমন সব দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্বকে বিপদের দিনে আমাদের ছাত্র যুবকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ধন্যবাদ ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

 

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com