1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
মঙ্গলবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৩:৪১ অপরাহ্ন

যে ৫ বিষয়ে বিএনপি-নাগরিক কমিটির ঐকমত্য দরকার

সাইমুম পারভেজ
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

এক অস্থির ও ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি। একদিকে দীর্ঘ দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী নিপীড়ন ও অপশাসন শেষে গণতন্ত্রকামী জনতার মুক্তি মিলেছে এক স্বতঃস্ফূর্ত গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। অন্যদিকে কবে একটি নির্বাচিত সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের হাল ধরবে, তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি। নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও সুনির্দিষ্ট করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষণা করা হয়নি।

এই অন্তর্বর্তী সময়ে প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পতিত স্বৈরাচার ও তার মিত্ররা ছোট ছোট মিছিল, লিফলেট বিতরণ ও অনলাইনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ফিরে আসার পথ খুঁজছে।

তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আট শর বেশি ডকুমেন্টেড হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার পরও শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কারও মধ্যেই প্রকাশ্য কোনো অনুশোচনার কথা শোনা যায়নি।

এ ধরনের নির্বিচার হত্যার নির্দেশ কে দিল, কারা তা বাস্তবায়ন করল, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের তাতে কী ভূমিকা ছিল, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো আত্মসমালোচনাও খেয়াল করা যায়নি। বরং ভবিষ্যতে প্রতিশোধ ও খুনের হুমকি এসেছে কিছু আওয়ামী লীগপন্থী অনলাইন অ্যাকটিভিস্টের কাছ থেকে।

অন্যদিকে হাসিনা সরকারের পতনের পর কর্তৃত্ববাদবিরোধী গোষ্ঠী ও দলগুলোর মধ্যেও নানা বিষয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতের কৌশলগত ঐক্য আর নেই বলেই মনে হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নাগরিক কমিটি দল গঠন শুরু করেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভিন্নমত গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে এবং এ ধরনের ভিন্নমত জনগণের জন্য বিকল্প পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করে। তবে এই বিভেদ যদি ‘বৃহত্তর আওয়ামী কর্তৃত্ববাদবিরোধী ঐক্য’কেই ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে, তবে এ আন্দোলনে যুক্ত থাকা সব দলই একযোগে বিপদে পড়তে পারে এবং আওয়ামী লীগের ফিরে আসা সহজ হতে পারে।

বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও উত্তর ইউরোপের দেশগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে কার্যকর গণতন্ত্র কীভাবে টিকে রয়েছে, তা নিয়ে একাডেমিক গবেষণাও রয়েছে। এসব গবেষণা অনুযায়ী, রাষ্ট্রের পলিসি বা নীতিগত বিরোধকে গণতান্ত্রিক দেশগুলো স্বাগত জানায়, কিন্তু রাষ্ট্র গঠনের প্রথম থেকেই কিছু মূল বিষয়ে একমত থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে বিরোধ সুপরিচিত, কিন্তু রাষ্ট্রের মূল বিষয়ে, যেমন জাতীয় নিরাপত্তা, রাষ্ট্রপরিচালনা কাঠামো ও পররাষ্ট্রনীতিতে তাদের মোটাদাগে ঐকমত্য রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে ব্রেটন উডস সংগঠন, যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ওপর এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাতিসংঘে আস্থা রাখা এই ঐকমত্যেরই অংশ।

একই কথা যুক্তরাজ্যের লেবার ও কনজারভেটিভদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো জনতুষ্টিবাদী নেতা ক্ষমতায় আসার পরও যুক্তরাষ্ট্রের মূলনীতিতে যে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে, সেটা বলা যায় না। অর্থাৎ কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছা যায়, সেটা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও লক্ষ্য নিয়ে দ্বিমত নেই উদারতাবাদী গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে। দীর্ঘ সময় ধরে এই ঐকমত্য দেশগুলোকে স্থিতিশীলতা দিয়েছে এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক উন্নতিকে ত্বরান্বিত করেছে।

বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশকে একটি বিশেষ সুযোগ এনে দিয়েছে এ ধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার। ক্ষমতায় গেলে কী ধরনের নীতি নেওয়া হবে, তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক ও দ্বিমতকে স্বাগত জানিয়েই পাঁচটি মূল বিষয়ে বিএনপি ও শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন নাগরিক কমিটির ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা দরকার।

১. শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ: জুলাই-আগস্টে নির্বিচার মানুষ হত্যা ও গুরুতর আহত করা হয়েছে। অন্ধ হয়েছেন, হাত-পা হারিয়েছেন হাজারো মানুষ। এর মধ্যে শিশুসহ নানা বয়সের, নানা ধর্ম ও মতের মানুষ রয়েছেন। এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ড কোনো সাধারণ ক্ষমতার পরিবর্তনের অংশ নয়। বরং এটি আদেশের ভিত্তিতে ঘটানো মানবতাবিরোধী অপরাধ। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের আগেও গত দেড় দশকে সুপরিকল্পিতভাবে হাজারো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, শেখ হাসিনা বা শীর্ষ পর্যায়ের আদেশ ছাড়া কোনো বাহিনীর স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এমন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে তা শুধু আইনগত বিষয় নয়, এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও বটে। তাই গণতন্ত্রকামী দলগুলোর উচিত, সবার আগে এ বিষয়টি সম্পর্কে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো। শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।

২. আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও বিচার: আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের মতো ‘দ্রুত সমাধান’ নিয়ে অনেককে যেমন আগ্রহী হতে দেখা যায়, বিচার নিয়ে ততটা নয়। একটি রাজনৈতিক দলকে গণহত্যার দায়ে নিষিদ্ধ করা যেতেই পারে, কিন্তু ‘শুধু নিষিদ্ধ’ কোনো সমাধান নয়, বরং উপযুক্ত বিচার ও পুনর্বাসন ছাড়া নিষিদ্ধ করা আওয়ামী লীগের জন্য লাভজনক হবে। তাই প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপি ও নাগরিক কমিটির উচিত আওয়ামী লীগের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো।

আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এ ধরনের বিচার করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। বিচারের জন্য সাক্ষ্য–প্রমাণ জোগাড় এবং প্রতিশোধ ছাড়া সুষ্ঠু বিচার করা জটিল ও দুরূহ। রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া মানসম্মত ও গ্রহণযোগ্য বিচার সম্ভব নয়। একটি নির্বাচিত সরকারই এই বিচারপ্রক্রিয়া পরিচালনা করবে। তবে মোটাদাগে একটি ঐকমত্যে এক মাসের মধ্যেই পৌঁছানো সম্ভব।

বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে এবং ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘জাতির স্থপতিবৃন্দ’ তালিকা করে এই দুঃখজনক অধ্যায়ের ইতিবাচক পরিসমাপ্তি ঘটানো যায়। এ তালিকায় এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ও জিয়াউর রহমান থাকতে পারেন।

৩. মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঐকমত্য ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আশার কথা হচ্ছে বিএনপি ও নাগরিক কমিটি—দুই দলের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঐকমত্য রয়েছে। সহজ ভাষায়, ভারতপন্থী বা পাকিস্তানপন্থী নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি হতে হবে সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশপন্থী। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের আনুগত্য ও ইতিহাসের সমাধিত ইস্যুগুলোকে নিয়ে কোনো বিতর্ক তৈরির সুযোগ না দিতে বিএনপি ও নাগরিক কমিটিসহ সব বাংলাদেশপন্থী রাজনৈতিক দলের একমত হওয়া দরকার।

৪. বাংলাদেশি জাতির স্থপতি বিতর্ক: শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে উপস্থাপন করে, তাঁর সমালোচনাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত করে এবং তাঁর ওপর ‘দেবত্ব’ আরোপ করে একটি ধর্মীয় ‘কাল্ট’-এর নেতা বা ‘দেবতায়’ পরিণত করা হয়েছিল। আরিল্ড এঙ্গেলসেন রুড (২০২২)–এর গবেষণা অনুযায়ী, ‘সেক্যুলার দেবত্ব’ প্রক্রিয়ায় মুজিবের ওপর সার্বভৌমত্ব আরোপ করে বাংলাদেশের সার্বভৌম অস্তিত্ব ও মুজিবকে এক করে ফেলা হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে এবং ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘জাতির স্থপতিবৃন্দ’ তালিকা করে এই দুঃখজনক অধ্যায়ের ইতিবাচক পরিসমাপ্তি ঘটানো যায়। এ তালিকায় এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ও জিয়াউর রহমান থাকতে পারেন।

৫. মধ্যপন্থী বাংলাদেশ গঠন: বিএনপি, নাগরিক কমিটি এবং অন্য বাংলাদেশন্থী দলগুলো মধ্যপন্থার রাজনীতিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির মূলনীতি হিসেবে নিতে ঐকমত্য হতে পারে। আওয়ামী লীগ, তীব্র ডানপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির দলগুলো যেন তাদের গুপ্ত রাজনীতিকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে, তা নিয়ে দলগুলোর একসঙ্গে হওয়া প্রয়োজন। দেশের মধ্যকার রাজনীতিতে মধ্যপন্থা মেনে চলার সঙ্গে সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতিতেও তার প্রতিফলন দরকার।

বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত শিরদাঁড়াসম্পন্ন, পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে। একদিকে যেমন ভারতকে শত্রুরাষ্ট্র ভাবা ভুল হবে, অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী হবে। তাই মধ্যপন্থার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতিগুলো নিয়ে বাংলাদেশপন্থী দলগুলোর বৃহত্তর ঐকমত্যে পৌঁছানো প্রয়োজনীয়।

 ড. সাইমুম পারভেজ অসলোর নরওয়েজিয়ান স্কুল অব থিওলজি, রিলিজিয়ন ও সোসাইটির জ্যেষ্ঠ গবেষক (সহযোগী অধ্যাপক)।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com