বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মইনুল ইসলামকে ৩ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন পিলখানা হত্যাকা-ের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিশন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কমিশনপ্রধান বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সাবেক মহাপরিচালক এএলএম ফজলুর রহমানসহ কমিশনের অন্য সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
পিলখানা হত্যাকান্ডের পর মইনুল ইসলাম বিডিআরের মহাপরিচালক হন। পরবর্তীকালে বাহিনীটির নাম পরিবর্তন করে বিজিবি হলে তিনি এই বাহিনীর প্রথম ডিজি হন। মইনুল ইসলাম পিলখানায় বিদ্রোহ ও হত্যাকা-ের ঘটনায় গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতীয় কমিটিরও সদস্য ছিলেন। তার কাছে বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চান তদন্ত কমিশনের সদস্যরা। এ ব্যাপারে তিনি কথা বলেন। গত ২৪ ডিসেম্বর কানাডা যাওয়ার পথে তাকে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ফেরত দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে পিলখানা হত্যাকা-ের পর আলামত নষ্টের অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কমিশন পিলখানা হত্যাকান্ডের পর গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও সেনা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দিয়েছে। এই প্রতিবেদন দুটি হাতে পাওয়ার পর কমিশন তা পর্যালোচনা করে দেখবে। এ ছাড়া কমিশন পিলখানা ট্র্যাজেডির সময় প্রাণে বেঁচে যাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেওয়া শুরু করেছে। কথা বলবেন কারাবন্দি কয়েকজন বিডিআর সদসস্যের সঙ্গে। বিদেশে অবস্থানরত সাবেক সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদেরও বক্তব্য নেবে। বিদ্রোহের পর কেন দ্রুত সেনা অভিযান করা যায়নি, কে তাকে বারণ করেছিলেন- এসব বিষয়ে জানতে চাইবে তদন্ত কমিশন।
এ ছাড়া কারাবন্দি সাবেক মন্ত্রী ফারুক খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে তদন্ত কমিশন। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন সেনা তদন্ত আদালতের প্রতিবেদন সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন। দুই প্রতিবেদন সমন্বয়ের নামে ফারুক খান অনেক তথ্যই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে যুক্ত করতে দেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। হত্যাকান্ডের পেছনের কুশীলবদের তথ্য গোপন করতেই সমন্বয়ের নামে চারবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত জাতীয় তদন্ত কমিটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। তখন এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। এসব বিষয়ে তদন্ত কমিশন তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের পর পিলখানার বিভিন্ন গেটের সামনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হত্যাযজ্ঞে অংশ নেওয়া বিডিআর জওয়ানদের সমর্থনে মিছিল বের করে। কারা সেই মিছিল বের করেছিল, মিছিলে কে বা কারা নেতৃত্ব দিয়েছিল- এ বিষয়েও জানার চেষ্টা করছে তদন্ত কমিশন। এ ছাড়াও সেনা তদন্ত কমিটি ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মির্জা আজমসহ ওই সময় বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার বক্তব্য নেওয়ার জন্য ডেকেছিল। কিন্তু তাদের বেশির ভাগকেই তখন তদন্ত কমিটির কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। আবার যারা গেছেন, তাদের প্রশ্ন করতে দেওয়া হয়নি। কে বা কারা তাদের বারণ করেছিল- এ বিষয়ে জানতে সেনা তদন্ত কমিটির সঙ্গে কমিশন কথা বলবে বলে জানা গেছে। বিদ্রোহের আগাম খবর পেয়েও কেন তৎকালীন প্রশাসন এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি- এ বিষয়টিও জানার চেষ্টা করছে তদন্ত কমিশন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত জাতীয় কমিটির সদস্য ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির। তিনি গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, প্রথম তদন্ত কমিটিতে থাকা সদস্যরা নানাভাবে তদন্ত কমিটিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। তদন্তের নামে তামাশা শুরু করেন। তখন আমরা সেনাবাহিনীর সদস্যরা তদন্ত এগিয়ে নিতে শুরু করি। একপর্যায়ে তদন্তে সেনসেটিভ তথ্য পেতেই আমাকে তদন্তে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়। আমাকে শুধু স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য ডাকা হতো। তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করে আমাকে স্বাক্ষর করতে বলা হয়। প্রথমে দশটি সাদা পাতা নিয়ে আসা হয়েছিল স্বাক্ষরের জন্য। আমি স্বাক্ষর করিনি। এর পর একটি মাত্র কপি রেডি করে সই করতে বলা হয়। সাইন করার সময় পুরো রিপোর্ট দেখার সুযোগ আমার ছিল না। আমি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি।
বিদ্রোহের সময় বিডিআর ৩ নম্বর গেটের সামনে বিডিআরের পক্ষে স্লোগান দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ বিষয়ে হাসান নাসির বলেন, তদন্তে আমি যে পর্যন্ত ছিলাম, সে পর্যন্ত এটা উল্লেখ ছিল। স্লোগান দেওয়ার বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছিল।
পিলখানা হত্যাকান্ডের আগে বিডিআর জওয়ানদের একটি গ্রুপ ব্যারিস্টার তাপসের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করে। তার হাতে দাবি-দাওয়াসংলিত লিফলেট দেওয়া হয়। কিন্তু কেন তাপস এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে বলেননি এ বিষয়টিও জানার চেষ্টা চলছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগেই ব্যারিস্টার তাপস বিদেশে পালিয়ে যান।
বিডিআর বিদ্রোহ ও পিলখানায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এর ৪৮ ঘণ্টা পর বাহিনীটির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান মইনুল ইসলাম। ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির ওই রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর সীমান্তরক্ষা বাহিনীর নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও।
Leave a Reply