অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই, পূর্বের এক্সেস টু ইনফরমেশন) প্রকল্পের ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বহুমুখী দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের মধ্যে সরকারের নিয়োগকৃত পাঁচ পরামর্শককে এরই মধ্যে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে পদে পদে অনিয়ম এবং ক্ষমতার অপব্যহার করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন প্রকল্পে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) নিয়োগ দেওয়া ৯ পরামর্শক। ইউএনডিপির কর্মী হওয়ায় ৯ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। আইসিটি বিভাগের গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি এ কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন আইসিটি বিভাগে জমা দিয়েছে।
ইউএনডিপি বলেছে, অভিযুক্ত কর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা অনিয়মের তদন্ত করছে সংস্থাটি। যদিও অভিযুক্ত কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে ইউএনডিপির মূল ভবনে কাজ করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন এটুআই প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে।
জানতে চাইলে এটুআই প্রকল্পের পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মামুনুর রশিদ ভূঁইয়া গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। বাকিরা ইউএনডিপির নিয়োগকৃত হওয়ায় তারা বিষয়টির তদন্ত করছে। এটা আমাদের হাতে নেই।’
অভিযুক্ত পাঁচ সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের অনিয়ম : অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে অব্যাহতিপ্রাপ্ত পাঁচ কর্মকর্তা হলেন- এসপিএসের সিনিয়র কনসালটেন্ট এইচ এম আসাদ-উজ্জামান, ই-নথি ইমপ্লিমেন্টেশন এক্সপার্ট এটিএম আল ফাত্তাহ, সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তানভীর কাদের ইমন, অ্যাডমিনের কনসালটেন্ট মো. ওমর ফারুক ও প্রকিউরমেন্ট বিষয়ক সিনিয়র কনসালটেন্ট মো. সালাউদ্দিন। তাদের মধ্যে আসাদ-উজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রকল্পের অর্থ লুটপাট; ইমনের বিরুদ্ধে ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়ম; ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে অবৈধ বিল ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ সম্পদ অর্জন ও বিদেশ সফরের প্রমাণ; সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে কেনাকাটায় অনিয়ম এবং আল ফাত্তাহের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
অভিযুক্ত ইউএনডিপির ৯ কর্মকর্তা ও তাদের অনিয়ম : অন্যদিকে, ইউএনডিপির নিয়োগকৃত বাকি ৯ জন হলেন এটুআইয়ের নীতিমালা উপদেষ্টা আনির চৌধুরী, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট মো. মাজেদুল ইসলাম, পরামর্শক ই-গভর্মেন্ট অ্যানালিস্ট ফরহাদ জাহিদ শেখ, প্রজেক্ট এনালিস্ট (এইচডি মিডিয়া) পূরবী মতিন, ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট
স্পেশালিস্ট মানিক মাহমুদ, রিসোর্স মোবিলাইজেশন স্পেশালিস্ট মো. নাসের মিয়া, ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস স্পেশালিস্ট তহরুল হাসান টুটুল, সলিউশন আর্কিটেকচার স্পেশালিস্ট রেজওয়ানুল হক জামি ও টেকনোলজি অ্যানালিস্ট মো. হাফিজুর রহমান।
আইসিটি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরি বলেন, নীতিমালা অ্যাডভাইজার আনীর চৌধুরী বর্তমানে পলাতক। আমরা তদন্ত প্রতিবেদন ইউএনডিপিকে দেওয়ার পর তারা আনীর চৌধুরীকে কার্যক্রমের বাইরে রেখেছে। তাকেসহ বাকিদের বিরুদ্ধে বর্তমানে ইউএনডিপির তদন্তকাজ চলমান রয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছে।
আইসিটি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি, ব্যাপক বিদেশ সফর, অফিস শেষে ক্লাবে নেশায় মত্ত থাকা, এক ভাউচার একাধিক জায়গায় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, মানিলন্ডারিং, নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণের মতো অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। তদন্তের সীমাবদ্ধতা থাকলেও অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ অভিযোগেরই সত্যতা পেয়েছে কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, ইউএনডিপির পলিসি অ্যাডভাইজর আনীর চৌধুরী দেশের আইসিটি সেক্টরের নানান অপকর্মের মূল হোতা- এমন অভিযোগের তদন্ত করেছে কমিটি। নির্দিষ্ট কোম্পানিকে বার বার কাজ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া, কাজ পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সহকর্মীদের সরাসরি নির্দেশনার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা না হয়েও সরকারি পাসপোর্ট ব্যবহার করার বিষয়টিকে বিধিবহির্ভূত বলছে তদন্ত কমিটি।
অভিযোগ তদন্ত করে পর্যালোচনা ও মতামতে কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- আনীর চৌধুরী এটুআই প্রোগ্রামের শুরু থেকে নেতৃত্ব দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার নাগরিকত্ব রয়েছে তার। অভিযোগ আছে, তিনি সাবেক আইসিটি উপদেষ্টা জয় ও সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলকের ঘনিষ্ঠ জন হওয়ায় ইউএনডিপি ও এটুআইয়ের ওপর তার ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন। তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত সংস্থা থেকে আরও অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, এটুআই প্রকল্পের প্রোগ্রাম অ্যাডভাইজার আনীর চৌধুরীর নির্দেশ বাস্তবায়নকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট মো. মাজেদুল ইসলাম। আরেক পরামর্শক ই-গভর্মেন্ট অ্যানালিস্ট ফরহাদ জাহিদ শেখের বিরুদ্ধে ইউএনডিপির পরামর্শক হয়েও বিধিবহির্ভূতভাবে সরকারি পাসপোর্ট ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে।
প্রচারণামূলক কাজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে প্রজেক্ট অ্যানালিস্ট (এইচডি মিডিয়া) পূরবী মতিনের বিরুদ্ধে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মতিন বিভিন্ন ভেন্ডরের নামে কাজ নিয়ে নিজস্ব টিম বা প্রোডাকশন ইউনিটের মাধ্যমে কাজ করে নিজেই অর্থ গ্রহণ করতেন। দীক্ষা প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে ফি নিয়ে তিনি এটুআই প্রকল্পে ইউএনডিপির চুক্তি লঙ্ঘন করেছেন। পরামর্শক ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট মানিক মাহমুদের বিরুদ্ধে নারী উদ্যোক্তা ও সহকর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও অশোভন আচরণের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
রিসোর্স মোবিলাইজেশন স্পেশালিস্ট মো. নাসের মিয়ার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এটুআই প্রকল্পের কেনাকাটায় ইউএনডিপি ও সরকারি উভয় উৎস থেকে একই কেনাকাটা দেখানোর ঘটনায়ও সম্পৃক্ত তিনি। ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস স্পেশালিস্ট তহরুল হাসান টুটুলের বিরুদ্ধে ‘একপে’ প্ল্যাটফর্মের অ্যাকাউন্টে অর্জিত সুদ ও সার্ভিস ফি’র টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
সলিউশন আর্কিটেকচার স্পেশালিস্ট রেজওয়ানুল হক জামির বিরুদ্ধে এটুআই ব্যবহার করে ই-কমার্স বাণিজ্যে ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি বিনিয়োগ এবং সরকারি ডাক ব্যবস্থা ব্যবহার করে ‘একশপ’, ‘একপাস’, ‘ডিজিবক্স’ ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে জনগণের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। টেকনোলজি অ্যানালিস্ট মো. হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে কেনাকাটায় অনিয়ম এবং ভেন্ডারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ তদন্ত করেছে কমিটি।
এদিকে, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা তদন্তে পাওয়া গেলেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এটুআই সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্পটির এক কর্মকর্তা বলেন, আইসিটি বিভাগের তদন্ত কমিটি গঠনের পর থেকেই অভিযুক্তরা নানাভাবে এটিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি তদন্ত রিপোর্ট নিজেদের পক্ষে নেওয়ার জন্য তদন্ত কমিটিকে দেড় কোটি টাকা দেওয়ার প্রলোভনের ফাঁদও পাতেন তারা। তদন্তে সময়ক্ষেপণের নামে নিজেদের কর্মীদের আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে কিনাÑ সেই প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ।
ইউএনডিপি বলছে, তারা এটুআই প্রকল্পের ৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে অবগত এবং তদন্ত প্রতিবেদনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। আইসিটি বিভাগের তদন্ত কমিটির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন তাদের নিরীক্ষা ও তদন্ত অফিসে জমা দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, বর্তমানে তারা অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে নীতি লঙ্ঘন করেছেÑ এমন যে কোনো কর্মীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে তারা।
এর আগে, গত বছরের ৩১ আগস্ট অভিযুক্ত পরামর্শকদের বিষয়ে তদন্ত করতে তৎকালীন আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মুহম্মদ মেহেদী হাসানকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করে আইসিটি বিভাগ। পরবর্তী সময়ে অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্তদের বক্তব্য লিখিত জবাব (প্রমাণসহ) জানতে চায় কমিটি। এর জবাবে বাংলাদেশ সরকারের পাঁচজন পরামর্শক তাদের লিখিত জবাব দিলেও তদন্ত কমিটির কাছে কোনো জবাব দেননি ইউএনডিপির ওই ৯ পরামর্শক। এদের মধ্যে সল্যুশন আর্কিটেকচার স্পেশালিস্ট রেজওয়ানুল হক জামি ১৪ অক্টোবর লিখিত জবাব জমা দিয়েও ১৫ অক্টোবর তা প্রত্যাহার করে নেন। বাকিরা ইউএনডিপির কর্মী হওয়ায় জবাব না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান।
Leave a Reply