একটি দেশের উন্নতি, নাকি অবনতি, অগ্রসরমান সমাজব্যবস্থা, নাকি পশ্চাদদিকে যাত্রা, মানুষের সাংস্কৃতিক মানের অগ্রগতি, নাকি নিম্নগামিতা-এসব বিষয়ের মীমাংসা বহুলাংশে নির্ভর করে সেই দেশের সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ওপর। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে প্রতিনিয়তই সুচিন্তার মাধ্যমে এর আধুনিকায়ন করা হয়। দেশের মানুষ যদি একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজে বাস করতে পারে, তাহলে দেশটির শাসনব্যবস্থাও সুদৃঢ় হয়। মানুষ শান্তিতে বাস করতে পারে। দেশের মানুষ যখনই ন্যায়বিচারবঞ্চিত হয়, তখনই সর্বক্ষেত্রে হতাশা দেখা দেয়, নিরাপত্তাহীনতাবোধ ও অরাজকতা সমাজকে অস্থির করে তোলে। দেশে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান হয়েছে, তাতে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। গত ১৫ বছর দেশে ফ্যাসিবাদের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল বলে ন্যায়বিচারও মুখ থুবড়ে পড়েছিল। বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করার এক অপচেষ্টা দেখেছি আমরা, এসবের কুফলও ভোগ করতে হয়েছে জাতিকে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার স্বৈরাচারের জঞ্জাল সরাতে গিয়ে নানামুখী চাপের মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায়ও সরকারকে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করতে হবে।
দেশের বিচারব্যবস্থার একটি বড় সীমাবদ্ধতার দিক হলো মামলার আধিক্যের বিপরীতে বিচারকের সংখ্যাস্বল্পতা। একজন বিচারককে এত মামলা ডিল করতে হয় যে, একটার পর একটা নথিতে স্বাক্ষর করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আবার মামলার সংখ্যাধিক্যের কারণে বাদী-বিবাদীগণ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আদালত প্রাঙ্গণে ঘুরতে ঘুরতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলার রায় দেখে যেতে পারেন না, তার আগেই অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। কখনো আবার বিচারপ্রার্থী ও আসামি, উভয়পক্ষের সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত থাকতে হয় আদালত প্রাঙ্গণে। মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত গরিব শ্রেণির পক্ষে যাতায়াত, খাওয়া ইত্যাদির পেছনে যে খরচ হয়, তা বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েও অনেকে আদালত প্রাঙ্গণে অতিরিক্ত সময় পার করতে বাধ্য হন। অনেকে মামলা চালাতে গিয়ে আর্থিকভাবে নিঃশেষ হয়েছেন, এমন উদাহরণও রয়েছে। সুতরাং বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। আদালতের সংখ্যাও বাড়ানো দরকার। একটা কথা চালু আছে, Justice delayed justice denied. তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারকার্য সম্পাদন করা হলে আমরা এটা ন্যায়ভিত্তিক সমাজের দিকে এগিয়ে যাব, সন্দেহ নেই। মামলার রায় প্রদান বিলম্বিত না হলে মামলার জটও কমে যাবে, নিঃসন্দেহে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, সরকার জনগণের স্বার্থে বিজ্ঞ পিপি, এপিপি, লিগ্যাল এইড ইত্যাদি নিয়োগ দিয়ে থাকেন, কিন্তু বিচারপ্রার্থীরা কারও কারও কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা পান না। আবার কখনো কখনো আইনজীবীরা বাদী-বিবাদীর কাছ থেকে ন্যায্য ফি’র অতিরিক্ত আদায় করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে বিচার বিভাগের দিকে নজর দিতে হবে সবচেয়ে বেশি। গত রেজিমে নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তারের অপচেষ্টা হয়েছে। বিশেষত বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের মামলার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রচুর মিথ্যা মামলাও হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে কারও বিরুদ্ধে যেন মিথ্যা মামলা দেওয়া না হয়। ইতোমধ্যে অনেক নিরপরাধকে, এমনকি হত্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ প্রশাসন যেন কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করতে না পারে, সে ব্যাপারে সরকারকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কেউ যেন মিথ্যা মামলা দায়ের করতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমরা লক্ষ করছি, গত রেজিম কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না। পুলিশে মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তারা যাতে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। থানার পুলিশ, ইউএনও, ডিসি অফিস ইত্যাদি স্থানীয়ভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলে এবং পরামর্শ প্রদানের ব্যবস্থা থাকলে মামলার সংখ্যা কমে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এতে ভুক্তভোগীদের হয়রানিই কমবে না শুধু, বেঁচে যাবে অর্থের জোগান ও কর্মঘণ্টা।
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, দেশে কারও বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা খুব সহজ কাজ। মামলা দায়েরের উপযুক্ত কারণ আছে কিনা, মামলা গ্রহণ করার প্রাথমিক যুক্তি আছে কিনা, তা সঠিকভাবে যাচাই করা হলে এমনিতেই প্রতিশোধপরায়ণতার মামলার সংখ্যা কমে যাবে নিশ্চয়ই।
এটা অনস্বীকার্য যে, কারও একার পক্ষে কিংবা কোনো একটি বিশেষ সংস্থার পক্ষে মামলার জট নিরসন কিংবা বিলম্বিত রায়ের অবসান ঘটানো সম্ভব নয়। এটি একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। বিজ্ঞ বিচারক, সৎ আইনজীবী, আইন-আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, সর্বোপরি জনসাধারণের সহযোগিতা- এই সব ফ্যাক্টরের সমন্বয় ঘটাতে পারলেই সুবিচার ও দ্রুত বিচার সম্ভব হয়ে উঠবে।
আমরা এই মুহূর্তে যে বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আছি, এই বাংলাদেশ এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধে সীমাহীন আত্মত্যাগ, অসংখ্য শহিদের রক্তদান, নয় মাসের অসহনীয় বিড়ম্বনা জীবন শেষে আমরা স্বাধীন হয়েছি। আবার ৫৩ বছর পর আমরা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পেয়েছি স্বৈরাচারমুক্ত এক গণতান্ত্রিক দেশ। এই অভ্যুত্থানেও রক্ত ঝরেছে অজস্র। মুক্তিযুদ্ধের রক্ত এবং জুলাই-আগস্টের রক্তের প্রতি আমাদের যেন শ্রদ্ধাবোধ থাকে। আমার লক্ষ করছি, নানা ধরনের অপশক্তি বর্তমান সরকারকে অকার্যকর করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সরকারের সংস্কার কার্যক্রম তাই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা যে সুযোগ পেয়েছি, সেই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষকে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে অবশ্যই। আরেকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত মনে করি। আর সেটা হলো, একাত্তর ও চব্বিশের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। ’৭১-এ আমরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়েছি, ’২৪-এর লড়াইটাও ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সুতরাং এই দুই লড়াইয়েরই চেতনাকে ধারণ করতে হবে আমাদের। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটি নয়। ১৯৫২ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত আমাদের যে ইতিহাস, সেটা রক্ত ঝরানোর ইতিহাস। আমরা আর রক্ত ঝরাতে চাই না। দেশটাকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটাই হোক আমাদের ব্রত।
এমএ মান্নান : মুক্তিযোদ্ধা ও প্রকৌশলী
Leave a Reply