ক্ষমতা ছেড়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর শেখ হাসিনার চূড়ান্ত গন্তব্য কোথায় হবে, সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পরিষ্কারভাবেই জানিয়েছেন যে শেখ হাসিনার জন্য ভারত শেষ গন্তব্য নয়।
তিনি জানান, খুব কম সময়ের নোটিশে শেখ হাসিনা ‘সাময়িকভাবে’ ভারতে আসার অনুমতি চান।
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় জানান, তার মা কোথাও রাজনৈতিক আশ্রয় চাননি।
তাহলে শেখ হাসিনার গন্তব্য কোথায় হবে?
ব্রিটেন, আমেরিকা কিংবা অন্য কোনো পশ্চিমা দেশ কি তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেবে?
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব কিছুই নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো বিষয়টিকে কিভাবে দেখছে তার ওপর।
পশ্চিমে আশ্রয় পাওয়া কঠিন হবে
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ-এর গবেষক টম কিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া শেখ হাসিনার জন্য খুব ‘কঠিন’ হবে। এমনকি সম্ভব নাও হতে পারে।
গত কয়েকদিনে খবরা-খবর বের হয়েছে যে শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তেও পুলিশ এবং সেনা বাহিনীকে আরো বেশি বল প্রয়োগ করতে বলেছিলেন। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনিস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, পশ্চিমা কোন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া শেখ হাসিনার জন্য খুব কঠিন হবে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে, বিশেষ করে গত কয়েকদিনে যা ঘটেছে, সেটা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো খুবই মর্মাহত হয়েছে।
কুগেলম্যান বিবিসি বাংলাকে বলেন, নিরাপত্তা বাহিনী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে যে প্রবল শক্তি প্রয়োগ করেছে এবং শেখ হাসিনা সরকারের যে দমন-পীড়ন ছিল সেটি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর খুবই আপত্তি ছিল।
‘এটা শেখ হাসিনার জন্য খুবই চিন্তার বিষয় হবে কারণ তার পরিবারের অনেক সদস্য পশ্চিমা দেশগুলোতে বসবাস করে। শেখ হাসিনার মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে যেসব দেশ মাথা ঘামায় না, তারা হয়তো তাকে আশ্রয় দিতে পারে। এটা পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে কোনো দেশ হতে পারে, কিংবা গাল্ফ দেশগুলোতে হতে পারে,’ বলেন কুগেলম্যান।
ছাত্র বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনী যে শক্তি প্রয়োগ করেছে সেটির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিল। তারপরেও শক্তি প্রয়োগ করা থেকে শেখ হাসিনা সরকারকে নিবৃত্ত করা যায়নি।
‘সে চেয়েছিল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আরো বেশি মানুষ হত্যা করতে,’ বলেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ-এর টম কিন।
তিনি মনে করেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যদি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিষয়গুলো তদন্ত করে এবং কোনো বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়, সেটি ভিন্ন পরিস্থিতির তৈরি করবে।
সেক্ষেত্রে তিনি ব্রিটেনে থাকলেও নিরাপদে থাকতে পারবেন না।
অতীতে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, পতিত স্বৈরাচারদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার নজির রয়েছে ইউরোপ কিংবা আমেরিকায়। কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ক্ষমতাচ্যুত একনায়কদের আশ্রয় দিয়েছে সৌদি আরব।
তাহলে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যতিক্রম হতে পারে কেন?
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব ঘটনা ঘটেছে স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায়। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। তাদের পতনের পর ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন।
টম কিন বলেন, ‘বাংলাদেশে যা হয়েছে সেটি সবাই দেখেছে। প্রচুর ভিডিও-ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে। ২০-৩০ বছর আগে বিষয়গুলো এতো দ্রুত ছড়াতো না। যে পরিমাণ রক্তপাত হয়েছে এবং শেখ হাসিনার প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে সেটি বেশ নেতিবাচক।’
‘স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপ এবং আমেরিকা তাদের মিত্রদের আশ্রয় দিয়েছে। আমার মনে হয় না শেখ হাসিনার প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা আছে,’ এ কথা উল্লেখ করে টম কিন বলেন, শেখ হাসিনা অতীতে কখনো কখনো পশ্চিমাদের পছন্দের তালিকায় যেতে পেরেছে, কিন্তু মিত্র হয়ে উঠতে পারেনি।
তাছাড়া ইউরোপ এবং আমেরিকায় অনেক বাংলাদেশী বসবাস করেন। সম্প্রতি ছাত্র বিক্ষোভে তাদের অধিকাংশ সমর্থন যেমন দিয়েছেন, তেমনি শেখ হাসিনার বিচারের দাবিতেও সরব হয়েছেন।
টম কিন বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশীদের মধ্যে অনেকই আছেন যারা সেসব দেশের নীতি-নির্ধরানী পর্যায়ে বিষয়গুলো তুলে ধরতে পারেন। এ কারণেও শেখ হাসিনাকে আশ্রয় না দেয়ার বিষয়ে চিন্তা করবে পশ্চিমা সরকারগুলো।
স্বৈরশাসকরা কোথায় যায়?
স্বৈরশাসকদের হাত থেকে যখন ক্ষমতা ফসকে যায়, সেটা বেশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে তার জন্য। তাদের ক্ষমতা শেষের দিকে চলে আসে তখন শাস্তি, কারাদণ্ড কিংবা জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয়।
সেজন্য স্বৈরশাসকদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য তাদের সামনে এটাই একমাত্র পথ খোলা থাকে।
বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান, সামরিক অভ্যুত্থান এবং গৃহযুদ্ধের কারণে যখন ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়, তখন তারা দেশের বাইরে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে।
স্পেনের বার্সেলোনা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবদেল এসক্রেবা ফোলক এবং যুক্তরাষ্ট্রের নর্থয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডানিয়েল ক্রামারিক স্বৈরশাসকদের গন্তব্য নিয়ে গবেষণা করেছেন।
তারা লিখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দেখা গেছে, স্বৈরশাসকদের ক্ষেত্রে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া তাদের পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যত স্বৈরশাসক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তাদের মধ্যে ২০ শতাংশ নির্বাসনে গিয়েছিলেন।
অনেক সময় দেখা যায়, স্বৈরশাসকদের নির্বাসনে যাওয়ার বিষয়টি সঙ্ঘাত নিরসনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
যেমন- ১৯৭৯ সালে উগান্ডার বিদ্রোহী এবং তানজানিয়ার সৈন্যরা যখন উগান্ডার রাজধানী কাম্পালার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিন লিবিয়াতে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এরপর ১৯৮৬ সালে ফিলিপিন্সের স্বৈরশাসক ফার্ডিনান্ড মার্কোস জন-বিক্ষোভের মুখে আমেরিকার সহায়তায় দেশ ছেড়ে হাওয়াইতে যান।
একই সময়ে হাইতির স্বৈরশাসক জ্যঁ-ক্লদ ডুভেলি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ফ্রান্সে গিয়ে আশ্রয় নেন।
এই তিনটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, স্বৈরশাসকরা নির্বাচনে যাওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল নির্বিঘ্নে হয়েছিল। তাদের নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ না থাকলে পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হতে পারতো।
২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে শুরু হয় জন-বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভ ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে পরিচিত। এসব দেশের সরকার কোনো নির্বাচন ছাড়াই দশকের পর দশক ক্ষমতায় ছিলেন।
আরব বসন্ত প্রথম হয়েছিল তিউনিসিয়ায়। ২৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পর জনবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে সৌদি আরব পালিয়ে যান স্বৈরশাসক বেন আলী।
পরে সৌদি আরবে তার মৃত্যু হয়।
আরব বসন্তের পরের ধাক্কা এসে পড়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট হুসনি মুবারকের ওপর। তিনি প্রায় তিন দশক ক্ষমতায় ছিলেন।
মাত্র ১৮ দিনের বিক্ষোভে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন হুসনি মোবারক। তখন সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি তিনি।
এরপর তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১২ সালে যাবজ্জীবন দণ্ড হয় তার।
এর ছয় মাস পর এ দণ্ড বাতিল করা হয় ও পুনরায় বিচারের আদেশ দেয়া হয়। তাকে কায়রোর একটি সামরিক হাসপাতালে বন্দী রাখা হয়।
অবশ্য ২০১৭ সালে মিসরের সর্বোচ্চ আদালত তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় এবং তিনি মুক্তি পান। এরপর ৯১ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
আরেক স্বৈরশাসক লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির পরিণতি ছিল আরো ভয়াবহ। আরব বসন্তের প্রেক্ষাপটে লিবিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়।
গাদ্দাফি মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভ করতে গেলে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
৪২ বছর ক্ষমতায় থাকা গাদ্দাফি এক পর্যায়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়লে তাকে হত্যা করা হয়।
গাদ্দাফিকে উৎখাত করার জন্য ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সামরিক শক্তিও প্রয়োগ করেছিল তখন।
এছাড়া ১৯৭৯ সালে ইরানের মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ইসলামী বিপ্লবের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন। তার ক্ষমতাচ্যুতির মাধ্যমে ইরানের রাজতন্ত্রের অবসান হয়।
পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে তার সম্পর্ক ছিল বেশ ভালো। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি মিসরে নির্বাসনে ছিলেন।
তার বিরুদ্ধে যখন জনবিক্ষোভ প্রবল হয়ে ওঠে তখন পশ্চিমা মিত্ররা আলোচনা করেন কিভাবে তাকে পরিত্যাগ করা যায়।
এরপর অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছিল পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের ক্ষেত্রে। সেনাবাহিনীর সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন নওয়াজ শরীফ।
তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য সব বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।
কিন্তু আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং সৌদি বাদশার চাপে সেনাশাসক পারভেজ মোশারফ তাকে সৌদি আরবে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হন।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply