হক ও বাতিলের সঙ্ঘাতে বাতিলের অনুসারীদের সাথে যেমন শয়তান ও অপরাধীরা থাকে তেমনি ঈমানদারদের সাথে থাকে ফেরেশতারা। এক দিকে বাতিলপন্থীদের কৃতকর্মগুলোকে তাদের সঙ্গী-সাথীরা সুদৃশ্য করে দেখায় এবং তাদেরকে এ মর্মে নিশ্চয়তা দেয় যে, হককে হেয় করার জন্য তোমরা যে জুলুম-অত্যাচার ও বেঈমানি করছ সেটিই তোমাদের সফলতার উপায় এবং এভাবে পৃথিবীতে তোমাদের নেতৃত্ব নিরাপদ ও সংরক্ষিত থাকবে। অপর দিকে হকপন্থীদের কাছে আল্লাহর ফেরেশতারা এসে সেই সুখবরটি পেশ করে, যা নিম্নের আয়াতে বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যারা ঘোষণা করেছে, আল্লাহ আমাদের রব, অতঃপর তার ওপর দৃঢ় ও অবিচল থেকেছে নিশ্চিত তাদের কাছে ফেরেশতারা আসে এবং তাদের বলে, ভীত হয়ো না, দুঃখ করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ শুনে খুশি হও তোমাদেরকে যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আমরা এই দুনিয়ার জীবনেও তোমাদের বন্ধু এবং আখিরাতেও। সেখানে তোমরা যা চাবে তাই পাবে। আর যে জিনিসেরই আকাক্সক্ষা করবে তাই লাভ করবে। এটি সেই মহান সত্তার পক্ষ থেকে মেহেরবানির আয়োজন, যিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।’ (সূরা হামিম আস সিজদা : ৩০-৩২)
যারা আল্লাহকে সুদৃঢ়ভাবে নিজেদের রব হিসেবে বিশ্বাস করেছে এবং যেই বিশ্বাসের মধ্যে সামান্যতম খাদ নেই। যারা রব বলে ঘোষণা করেই থেমে যায়নি এবং এ ভ্রান্তিতেও লিপ্ত হয়নি যে, আল্লাহকে রব বলে ঘোষণাও করেছে আবার তাঁর সাথে অন্যদেরকেও রব হিসেবে গ্রহণ করেছে; বরং একবার এ আকিদা পোষণ করার পর সারা জীবন তার ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকেছে, তার পরিপন্থী অন্য কোনো আকিদা গ্রহণ করেনি কিংবা এর সাথে কোনো বাতিল আকিদার সংমিশ্রণও ঘটায়নি এবং নিজের কর্মজীবনে তাওহিদের আকিদার দাবিগুলোও পূরণ করেছে। তাওহিদের ওপর দৃঢ় থাকার অর্থ নবী সা: ও বড় বড় সাহাবা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : হজরত আনাস রা: বর্ণনা করেন- নবী সা: বলেছেন, ‘বহু মানুষ আল্লাহকে তাদের রব বলে ঘোষণা করেছে; কিন্তু তাদের অধিকাংশই আবার কাফের হয়ে গেছে। দৃঢ় পদ সেই ব্যক্তি যে মৃত্যু পর্যন্ত এই আকিদা আঁকড়ে ধরে রয়েছে।’ (সুনানে নাসায়ি) হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা:-এর ব্যাখ্যা এভাবে- ‘এরপর আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করেনি, তাকে ছাড়া আর কোনো উপাস্যের প্রতি আকৃষ্টও হয়নি।’ (ইবনে জারির) একবার হজরত উসমান রা: মিম্বরে উঠে এ আয়াত পাঠ করে বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, নিজ আকিদায় দৃঢ় ও স্থির তারাই যারা দৃঢ়ভাবে আল্লাহর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শিয়ালের মতো এ দিক থেকে সে দিকে এবং সে দিক থেকে এ দিকে ছুটে বেড়ায়নি।’ (ইবনে জারির)
পৃথিবীতে যারা আল্লাহকে নিজেদের রব মেনে নিয়েছে এবং তার ওপর দৃঢ় অবিচল থেকেছে তারা যখন ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে সমুন্নত করার চেষ্টা চালায় তখন তাদের ওপর রাজ্যের খড়গ নেমে আসে। সবধরনের জুলুম, নির্যাতন, জেল-জরিমানা এমনকি জীবনপাতও করতে হয়। তারা আগে থেকে জানতেন, যে কাজের নিজেকে সম্পৃক্ত করেছে এটি বড়ই কণ্টকাকীর্ণ রক্তপিচ্ছিল পথ। তথাপি তারা এ পথকেই বাছাই করে নেন। যখন তারা ন্যায় ও সত্যের দুশমনদের হাতে নাজেহাল হতে থাকে সেই সময় ফেরেশতারা অননুভূত পন্থায় এবং মুমিনদের কানের পর্দায় প্রতিধ্বনিত হওয়ার পরিবর্তে হৃদয়ের গভীরে প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তির হয়ে প্রবেশ করে। ইসলামী জীবনব্যবস্থা সমুন্নতকারী বিশ্ববিখ্যাত কর্মীদের দেখেছি যে, এ কাজের জন্য হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বাতিলের সাথে আপস করেননি। ফাঁসির আগমুহূর্তে নিজের পরিবার ও সাথীদের সাথে ইসলামী জীবনব্যবস্থা সমুন্নত করার ধারা অব্যাহত রাখার নসিহত করেছেন। ফাঁসির মঞ্চে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে যাবেন, নাকি লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে যাবেন, তা নিজের ছেলের কাছে আলোচনা করেছেন। সরকারি প্রহরীদের সাধারণত অনেকটা টেনে-হিঁচড়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যেতে হয়; কিন্তু এমন অনেক বীর-মুজাহিদকে জানি, সরকারি প্রহরীরা বলার সাথে সাথেই কোনো প্রকার বিলম্ব ছাড়াই প্রহরীদের পেছনে ফেলে দ্রুতগতিতে ফাঁসির মঞ্চে এগিয়ে গেছেন। কোনো মানবীয় গুণ এ ধরনের কাজে তাকে নির্ভীক করেনি; বরং ফেরেশতারা তাদের হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফেরেশতারা তাদেরকে বলতে থাকে, ‘ভীত হয়ো না, দুঃখ করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ শুনে খুশি হও তোমাদেরকে যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।’
‘ভীত হয়ো না, দুঃখ করো না’ ফিরেশতাদের এই অভয়দান একটি ব্যাপক অর্থবোধক কথা, যা দুনিয়া থেকে আখিরাত পর্যন্ত ঈমানদারদের জন্য প্রশান্তির একটি নতুন বিষয় বহন করে। গুরুত্বপূর্ণ সেই সময়গুলো নিম্নরূপ :
প্রথমত, পৃথিবীতে ফেরেশতাদের এই উপদেশের অর্থ হচ্ছে, বাতিল শক্তি যতই পরাক্রমশালী ও স্বৈরাচারী হোক না কেন ফেরেশতারা বলতে থাকে, এদের দেখে কখনো ভীত হয়ো না এবং হকের অনুসারী হওয়ার কারণে যত দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনাই সইতে হোক সে জন্য দুঃখ করবে না। কেননা, ভবিষ্যতে তাদের জন্য এমন কিছু আছে যার কাছে দুনিয়ার সব নিয়ামত তুচ্ছ ও বড়ই নগণ্য।
দ্বিতীয়ত, মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা যখন এই কথাগুলো বলে তখন তার অর্থ দাঁড়ায়, তুমি সামনে যে গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছ সেখানে তোমার জন্য ভয়ের কোনো কারণ নেই। কারণ, সেখানে জান্নাত তোমার জন্য অপেক্ষমাণ। আর দুনিয়াতে তুমি যা কিছু ছেড়ে যাচ্ছ সে জন্য তোমার দুঃখ ভারাক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। কেননা, এখানে আমরা তোমাদের অভিভাবক ও বন্ধু। ফেরেশতারা বলবেন, ‘আমরা এই দুনিয়ার জীবনেও তোমাদের বন্ধু এবং আখিরাতেও।’ (সূরা হামিম আস সিজদা-৩১) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘হে প্রশান্ত আত্মা! চলো তোমার রবের দিকে, এমন অবস্থায় যে তুমি (নিজের শুভ পরিণতিতে) সন্তুষ্ট। শামিল হয়ে যাও আমার নেক বান্দাদের মধ্যে এবং প্রবেশ করো আমার জান্নাতে।’ (সূরা ফজর : ২৭-৩০) এরাই প্রশান্ত আত্মা যারা কোনো প্রকার সন্দেহ সংশয় ছাড়াই পূর্ণ নিশ্চিন্ততাসহকারে ঠাণ্ডা মাথায় এক ও লা-শরিক আল্লাহকে নিজের রব এবং নবীগণ যে সত্য দ্বীন এনেছিলেন তাকে নিজের দ্বীন ও জীবনবিধান হিসেবে গণ্য করেছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছ থেকে যে বিশ্বাস ও বিধানই পাওয়া গেছে তাকে সে পুরোপুরি সত্য বলে মেনে নিয়েছে। আল্লাহর দ্বীন যে জিনিসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তাকে সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নয়; বরং এই বিশ্বাসসহকারে বর্জন করেছে যে, সত্যিই তা খারাপ। সত্যপ্রীতির পথে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সে নির্দ্বিধায় তা করেছে। এই পথে যেসব সঙ্কট, সমস্যা, কষ্ট ও বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে হাসিমুখে সেগুলো বরদাশত করেছে। অন্যায় পথে চলে লোকদের দুনিয়ায় নানান ধরনের স্বার্থ, সম্পদ ও সুখ-সম্ভার লাভ করার যেসব দৃশ্য সে দেখেছে তা থেকে বঞ্চিত থাকার জন্য তার নিজের মধ্যে কোনো ক্ষোভ বা আক্ষেপ জাগেনি; বরং সত্য দ্বীন অনুসরণ করার ফলে সে যে এসব আবর্জনা থেকে মুক্ত থেকেছে, এ জন্য সে নিজের মধ্যে পূর্ণ নিশ্চিন্ততা অনুভব করেছে। কুরআনের অন্যত্র এই অবস্থাটিকে ‘শরহে সদর’ বা উন্মুক্ত হৃদয় করে দেয়া অর্থে বর্ণনা করা হয়েছে। (সূরা আনআম-১২৫)
তৃতীয়ত, আলমে বরজখ ও হাশরের ময়দানে যখন ফেরেশতারা এ কথাগুলো বলবে তখন তার অর্থ হবে- এখানে তোমাদের জন্য কেবল শান্তি আর শান্তি। পার্থিব জীবনে তোমরা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছ সে জন্য দুঃখ করো না এবং আখিরাতে যা কিছু সামনে আসবে সে জন্য ভয় করবে না। কারণ, আমরা তোমাদেরকে সে জান্নাতের সুসংবাদ জানাচ্ছি, যার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসা হচ্ছে।
মুমিনদের সান্ত্বনা দেয়া এবং মনোবল সৃষ্টির পর এখন তাদেরকে তাদের আসল কাজের প্রতি উৎসাহিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে- ‘সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে যে আল্লাহর দিকে ডাকল, সৎ কাজ করল এবং ঘোষণা করল আমি মুসলমান।’ (সূরা হামিম আস সিজদা-৩৩) আগের আয়াতে আল্লাহর বন্দেগির ওপর দৃঢ়পদ হওয়া এবং এই পথ গ্রহণ করার পর পুনরায় তা থেকে বিচ্যুত না হওয়াটাই এমন একটি মৌলিক নেকি, যা মানুষকে ফেরেশতার বন্ধু এবং জান্নাতের উপযুক্ত বানায়। এখন তাদের বলা হচ্ছে, এর পরবর্তী স্তর হচ্ছে, তোমরা নিজে নেক কাজ করো, অন্যদেরকে আল্লাহর বন্দেগির দিকে ডাকো এবং ইসলামের ঘোষণা দেয়াই যেখানে নিজের জন্য বিপদাপদ ও দুঃখ-মুসিবতকে আহ্বান জানানোর শামিল এমন কঠিন পরিবেশেও দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করো, আমি মুসলমান। অবশ্যই এটি দৃঢ়সংকল্প, সাহস, অপরিসীম সহনশীলতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। সাময়িকভাবে কেউ কোনো দুষ্কর্মের মোকাবেলায় সৎকর্ম করতে পারে। এটি কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে এমন সব বাতিলপন্থী দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জন্য লড়াই করতে হয়, যারা নৈতিকতার যেকোনো সীমা লঙ্ঘন করতে দ্বিধা করে না এবং শক্তি ও ক্ষমতার নেশায় বিভোর হয়ে আছে সেখানে সৎকর্ম দিয়ে অসৎ ও দুষ্কর্মের মোকাবেলা করে যাওয়া তাও আবার উচ্চমাত্রার সৎকর্ম দিয়ে এবং একবারও অসৎকর্মের প্রশ্রয় না দেয়া কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। মানুষের জন্য এর চেয়ে উচ্চস্তর আর নেই। কোনো ব্যক্তি আল্লাহকে রব হিসেবে স্বীকার করে সোজা পথ গ্রহণ করা এবং তা থেকে বিচ্যুত না হওয়া নিঃসন্দেহে বড় ও মৌলিক কাজ। কেবল সেই ব্যক্তিই এ কাজ করতে পারে যে বুঝে শুনে ন্যায় ও সত্যকে সমুন্নত করার জন্য কাজ করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছে, যে তার প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচারশক্তির অনুগত করে নিয়েছে এবং যার মধ্যে নেকি ও সততা এমন গভীরভাবে শিকড় গেড়েছে যে, বিরোধীদের কোনো অপকর্ম ও নোংরামি তাকে তার উচ্চাসন থেকে নামিয়ে আনতে পারে না।
আমি মুসলমান বলে কোনো ব্যক্তির ঘোষণা করা পরিণামের পরোয়া না করে সৃষ্টিকে আল্লাহর বন্দেগির দিকে আহ্বান জানানো এবং কেউ যাতে ইসলাম ও তার ঝাণ্ডাবাহীদের দোষারোপ ও নিন্দাবাদ করার সুযোগ না পায় এ কাজ করতে গিয়ে নিজের তৎপরতাকে সেভাবে পবিত্র রাখা হচ্ছে পূর্ণ মাত্রার নেকি। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘শোনো, যারা আল্লাহর বন্ধু, ঈমান এনেছে এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করেছে, তাদের কোনো ভয় নেই ও মর্ম যাতনার অবকাশ নেই। দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনে তাদের জন্য শুধু সুসংবাদই রয়েছে। আল্লাহর কথার পরিবর্তন নেই। এটিই মহাসাফল্য।’ (সূরা ইউনুস : ৬২-৬৪) অত্যন্ত উঁচু মর্যাদার মানুষই কেবল এই গুণাবলির অধিকারী হয়ে থাকে। আর যে ব্যক্তি এসব গুণের অধিকারী হয় দুনিয়ার কোনো শক্তিই তাকে সাফল্যের মনজিলে মাকসুদে পৌঁছা থেকে বিরত রাখতে পারে না। নীচ প্রকৃতির মানুষ তাদের হীন চক্রান্ত, জঘন্য কৌশল এবং কুৎসিত আচরণ দ্বারা তাকে পরাস্ত করবে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক
Leave a Reply