ইসরাইলের যুদ্ধ-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য মধ্যপন্থী রাজনীতিবিদ বেনি গ্যাঞ্জ রোববার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।
গ্যাঞ্জের এই পদক্ষেপ এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি কোন হুমকি নয়। কারণ সংসদে তার জোট সরকারের এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন আছে। তবে তিনি এখন জোটের উগ্র ডানপন্থী মিত্রদের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে যাবেন।
গ্যাঞ্জ অভিযোগ করেছেন, নেতানিয়াহু ‘সম্পূর্ণ বিজয়কে অসম্ভব’ করে তুলেছেন। তিনি বলেন, সরকারের উচিত হবে, গত অক্টোবর ৭ হামাস যাদের পণবন্দী করে নিয়ে গেছে, তাদের ফেরত আনাকে ‘রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে থাকার’ চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের আক্রমণের কয়েক দিন পরেই ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর এই সাবেক প্রধান নেতানিয়াহুর সরকারে যোগ দেন। সরকারে তার উপস্থিতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ইসরাইলের গ্রহণযোগ্যতা জোরদার করে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সাথে গ্যাঞ্জের ভালো সম্পর্ক আছে।
এর আগে গাঞ্জজ বলেছিলেন, নেতানিয়াহু যদি ৮ জুনের মধ্যে গাজার জন্য যুদ্ধ-পরবর্তী পরিকল্পনা তৈরি না করেন, তাহলে তিনি সরকার থেকে বিদায় নেবেন।
শনিবার রাতে তার একটি সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল। কিন্তু দিনের আগে গাজায় নাটকীয় অভিযানে ইসরাইলি বাহিনী চার পণবন্দী মুক্ত করার পর সেই সম্মেলন বাতিল করা হয়। গাজায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় অন্তত ২৭৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়।
নেতানিয়াহুর ঘোষণা
ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ৭ অক্টোবর হামাসের সন্ত্রাসী হামলার সময়ে পণবন্দিদের মধ্যে চারজনকে শনিবার ইসরাইলি সৈন্যরা উদ্ধার করার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতেনিয়াহু বলেন ইসরাইল সন্ত্রাসের কাছে হারবে না।
নেতেনিয়াহু বলেন, ‘ইসরাইল সন্ত্রাসবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে না। আমরা এটা চলতে দেবো না যে পর্যন্ত না আমাদের মিশন সম্পন্ন হচ্ছে এবং সব পণবন্দীকে আমরা ঘরে ফিলিয়ে আনতে পারছি, জীবিত ও মৃত সকলকেই।’ তিনি এই উদ্ধার অভিযানের পর তার দফতরের সিচিউশান রুমে এই বক্তব্য রাখেন।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গালান্ট বলেন শনিবারের এই উদ্ধার অভিযানটি ছিল কঠিন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমাদের সৈন্যরা গাজায় শাহরিক পরিবেশে প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে এই অভিযান চালিয়ে অত্যন্ত সাহস দেখিয়েছে।’
গাঞ্জ এটিকে ইসরাইলের প্রতিরক্ষায় তার ৪৭ বছরের চাকরিতে তার দেখা অভিযানগুলির মধ্যে অন্যতম, ‘সাহসী ও অসামান্য অভিযান’ বলে অভিহিত করেন।
নুসেইরাতে শিবিরে রক্তক্ষয়ী হামলা
গাজার নুসেইরাতে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এই ঘটনাকে যুদ্ধ শুরু হবার পর সব চেয়ে রক্তক্ষয়ী বলে বর্ণনা করেন বলে রয়টার্স জানায়। গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা রোববার নিহতের সংখ্যা ২১০ থেকে বাড়িয়ে ২৭৪ করেন।
এলাকাটি বিপুল জনসংখ্যা অধ্যূষিত। যদিও রয়টার্স এই ঘটনার সত্যতা তাত্ক্ষণিকভাবে যাচাই করতে পারেনি, সামাজিক মাধ্যমগুলোর ছবিতে এই ভয়াবহতা ধরা পড়েছে।
একজন প্যারামেডিক ও নুসেইরাতের অধিবাসী যিনি কেবল তার নামের প্রথম অংশ জিয়াদ বলে জানান, তিনি বলেন, ‘এ যেন ভয়ের চলচ্চিত্রের মতো কিন্তু এত ছিল বাস্তব ধ্বংসযজ্ঞ। ইসরাইলের ড্রোন ও যুদ্ধবিমানগুলো ইচ্ছেমতো সারা রাত লোকজনের বাড়িতে এবং যারা সেখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল তাদের ওপর আক্রমণ চালায়।
তিনি রয়টার্সকে একটি মেসেজিং অ্যাপের মাধমে জানান যে এই বোমা হামলায় একটি স্থানীয় বাজারকে এবং আল আওদা মসজিদকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়।
তিনি বলেন, চারজনকে মুক্ত করতে তারা ডজন ডজন নিরাপরাধ অসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেন যে একটি আবাসিক এলাকার কেন্দ্রস্থলে গোলাগুলির মাধ্যমেই এই উদ্ধার অভিযান চালানো হয় । তিনি বলেন, সেখানেই গাজার অসামরিক জনগণের মধ্যে হামাস বন্দিদের লুকিয়ে রেখেছিল আর এই সশস্ত্র লোকজন তাদের পাহারা দিচ্ছিল।
হাগারি বলেন, ইসরাইলি বাহিনী পাল্টা গুলি চালায় , বিমান আক্রমণও চালায়। পুলিশের একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এই অভিযানের সময়ে একজন ইসরাইলি সৈন্য নিহত হয়।
ইসরাইলের সেনাবাহিনী বলেছে, নোয়া আরগামানি (২৫), আলমগ মেইর জান (২১), আন্দ্রে কোজলভ (২৭) ও শ্লোমি জিভ (৪০)- এই চারজনকে তারা উদ্ধার করেছে। নুসেইরাতে দিনের বেলা এক জটিল ও বিশেষ অভিযান চালিয়ে এদের উদ্ধার করা হয়েছে। সেনাবাহিনী আরো বলেছে, নুসেইরাতের কেন্দ্রস্থলে দুটি জায়গা থেকে বন্দীদের উদ্ধার করা হয়।
হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়েহ শনিবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমাদের জনগণ আত্মসমর্পণ করবে না এবং এই অপরাধী শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের নিজেদের রক্ষা করার অধিকারের জন্য প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে।’ আরেক হামাস কর্মকর্তা বলেন, আট মাস আগে যুদ্ধ শুরু হবার পর ইসরাইলের মাত্র চারজন পণবন্দিকে মুক্ত করা, ‘অর্জন নয়, ব্যর্থতারই চিহ্ন।’
হামাস আরো বলে, তাদের হাতে সব চেয়ে বেশি সংখ্যক পণবন্দি রয়েছে এবং এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
এই উদ্ধার অভিযান এমন এক সময় চালানো হলো, যখন গাজায় অসামরিক লোকজনের সুরক্ষার জন্য ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে।
অস্ত্রবিরতির জন্য চাপ
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গাজায় জীবিত চারজন ইসরাইলি পণবন্দিকে স্বাগত জানান। প্যারিসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রঁর সাথে এক সংবাদ সম্মেলনে বাইডেন বলেন, তিনি তার স্বাগতিক দেশের সাথে মিলে পণবন্দির প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানাই। ‘আমরা ততদিন পর্যন্ত কাজ করে যাবো যতদিন না সব পণবন্দি ঘরে ফিরে আসছেন এবং অস্ত্রবিরতি হচ্ছে।’
শনিবার এক বিবৃতিতে হোয়াইট হাউসও আমেরকান নাগরিকসহ অবশিষ্ট সব পণবন্দির মুক্তি নিশ্চিত করতে সকল প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন জানায়।
যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি নতুন রোড ম্যাপ প্রস্তাব করার পর নভেম্বরে এক সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধবিরতির পর সংঘাতটিতে প্রথম যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতা করার সর্বসাম্প্রতিক প্রচেষ্টা শুরুর এক সপ্তাহ পরে স্থবির হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে যুদ্ধ শেষ করার জন্য চাপের মুখে বাইডেন বলেন, তিনি ছয় সপ্তাহের জন্য লড়াই বন্ধ করার জন্য পরিকল্পনা করেন। আর ইতোমধ্যেই ইসরাইলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দীদের বিনিময়ের পণবন্দীর মুক্তির ও প্রস্তাব দেয়া হয়।
এই পরিকল্পনায় গাজায় মানবিক সহায়তা বিতরণ জোরদার করারও কথা রয়েছে।
বিশ্ব শক্তির জি-সেভেন গ্রুপ এবং আরব রাষ্ট্রগুলি এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে। সাথে ১৬ জন বিশ্বনেতা হামাসকে চুক্তিটি মেনে নেয়ার জন্য বাইডেনের আহ্বানে যোগ দিয়েছেন।
হামাস এখনো বাইডেনের প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করলেও গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান কোনোটিই করেনি। তবে তারা স্থায়ী যুদ্ধবিরতির কথা আবারো বলেছে। ইসরাইল আলোচনার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, তবে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীটিকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ রয়েছে।
প্রধান মতবিরোধের বিষয়গুলোর মধ্যে হামাসের একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং ইসরাইলের পূর্ণ প্রত্যাহারের উপর জোর দেয়ার দাবি রয়েছে, যেই দাবিগুলো ইসরায়েল প্রত্যাখ্যান করেছে।
একটি নতুন কূটনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তার অষ্টম মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইসরাইল এবং প্রধান আঞ্চলিক অংশীদার মিসর, জর্ডান এবং কাতার সফরে যাচ্ছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই শীর্ষ কূটনীতিক ‘হামাসকে দেয়া প্রস্তাবটি গ্রহণ করার গুরুত্বের ওপর জোর দিবেন’ যাতে ‘ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি উভয়েরই উপকার হবে।’
সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা
Leave a Reply