বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসার পানির বিল পরিশোধের জন্য ৩০ জুনকে শেষ সময় বেঁধে দিয়ে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। পাঠানো বিলে ‘ভুয়া হিসাব’ দেখিয়ে তিন-চার গুণ বেশি অর্থ দাবি করা হয়েছে। ‘করোনা’র সুযোগে ভুয়া বিলের মাধ্যম ‘পাবলিকের’ কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কারসাজি হিসেবেই এটি করা হয়েছে। এ ঘটনা ভোক্তাদের মাথায় বজ্রপাতের মতো আঘাত হেনেছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে ‘বেঁচে থাকা’ আরও কষ্টসাধ্য করে তোলা হয়েছে। জনগণ দেখতে পারছে যে, সরকারের কাছে মানুষের জীবনের মূল্য কত কম। মানুষের ওপর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ প্রয়োগ করতে সরকারের কোনো দ্বিধা হয়নি।
‘করোনা মহামারী’ মানুষের স্বাভাবিক জীবন ল-ভ- করে দিয়েছে। তারা আজ এক মহাদুর্যোগে নিপতিত। ‘জীবনযুদ্ধে’ ও ‘জীবিকা যুদ্ধে’ মানুষ আজ দিশেহারা। হয় ‘করোনা’য়, না হয় ‘অনাহারে’, কখন কে যে মরবে আর কে যে বাঁচবে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা এখন নেই। দেশে যখন এমনই এক ভয়ার্ত বিপর্যয় ও অসহায়ত্বের অবস্থা বিরাজ করছে, তখন সরকার ভুয়া বিল দিয়ে মানুষের শেষ রক্তটুকুও শুষে নিতে চাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়। সরকার নতুন করে গ্যাস, বিদ্যুৎ প্রভৃতি জ্বালানির দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করেছে। সে যেন নিজের ইচ্ছামতো যখন-তখন জ্বালানির দাম বাড়াতে পারে, সে জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য একটি বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। এ এক সর্বনাশা দুঃসংবাদ।
বর্তমানে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ জ্বালানিসামগ্রীর পাইকারি ও খুচরা মূল্য এবং আনুষঙ্গিক আরও কিছু বিষয় সম্পর্কে নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা রয়েছে বিইআরসির হাতে। এ বিষয়ে এখন যে আইন আছে তাতে বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ জ্বালানির দাম বছরে মাত্র একবার বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু সরকার বছরে মাত্র একবার দাম বাড়িয়ে সন্তুষ্ট না। সে চায় যখন ইচ্ছা তখন দাম বাড়াতে। কিন্তু বর্তমান আইনে সে ক্ষেত্রে বাধা আছে। সরকারের মাথাব্যথা সেখানেই। তাই সরকার এখন তার নিজের করা আইন পরিবর্তনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ‘করোনা মহামারী’র অস্বাভাবিক মহাদুর্ভোগ কিছুটা কমতে শুরু করা পর্যন্ত অপেক্ষা করার মানবিক বিবেচনাটিকেও বিসর্জন দিয়ে সরকার জনগণের ওপর আরেকটি বিশাল ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছে। মানুষের দৃষ্টি এখন ‘করোনা’র দিকে আবদ্ধ থাকায় সেই অবস্থাটিকে বরং সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে সরকার তড়িঘড়ি করে এই গণবিরোধী আইন পাস করিয়ে নেওয়ার চাতুর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে।
গ্যাস, বিদ্যুৎ প্রভৃতি জ্বালানি হলো এমন ধরনের পণ্য, যার দাম বাড়লে সেসবের জন্য সংসার খরচই শুধু স্ফীত হয় না, তার প্রভাবে বাজারের অন্য সব জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যায়। ফলে জনগণের জীবনযন্ত্রণা তীব্রতর হয়ে ওঠে। এসব কথা জানা সত্ত্বেও সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো এবং তা যেন যতবার ইচ্ছা ততবার আইনসিদ্ধভাবে বাড়ানো যায়, সে জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। ‘করোনা বিপর্যস্ত’ দেশের মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের চেষ্টা করাটিই যেখানে এখন সরকারের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত, সেখানে সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ প্রভৃতির দাম বাড়িয়ে জনগণকে আরও বিপদাপন্ন করতে উদ্যত হয়েছে।
আওয়ামী শাসনের বর্তমান পর্বের আগের সরকারগুলো বিদ্যুৎ-গ্যাস-জ্বলানি খাতের ক্ষেত্রে দুর্নীতি-ভুলনীতি-লুটপাটের আশ্রয় নিয়ে তাকে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এক গভীর সংকটে নিপতিত করেছিল। দেশের ‘লুটেরা শাষকগোষ্ঠী’র উদ্দেশ্য ছিল, এই কৃত্রিম সংকটকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে এ খাতটিকে তাদের ‘লুটপাটের স্থায়ী উৎসে’ পরিণত করা।
আওয়ামী শাসনের বর্তমান পর্বে সরকার বেশ কয়েকবার বিভিন্ন জ্বালানির দাম এই কথা বলে বাড়িয়েছিল যে, ২০১৩ সালের পরে বিদ্যুতের দাম আর বাড়বে না। তরল জ্বালানিনির্ভর ভাড়াভিত্তিক (ৎবহঃধষ), দ্রুত ভাড়াভিত্তিক (য়ঁরপশ-ৎবহঃধষ) ইত্যাদি ধরনের অস্থায়ী ও আপৎকালীন কিছু স্থাপনা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে অল্প কিছুদিনের জন্য এই মূল্য বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। ২০১৪ সালের আগেই দেশ গ্যাস ও কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থা পরিচালনার মতো সক্ষমতা অর্জন করবে। তখন থেকে বিদ্যুতের দাম বাড়ার বদলে পর্যায়ক্রমে কমতে থাকবে। ‘মানুষকে তখন আর বিদ্যুতের জন্য ছুটে বেড়াতে হবে না, বরং বিদ্যুৎই তখন মানুষের পেছনে ছুটে বেড়াবে।’ ২০১৪ সাল থেকে এ ধরনের ‘সোনালি পরিস্থিতি’ সৃষ্টি হবে বলে সরকার দেশবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই স্বপ্ন দেখিয়ে সরকার ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে পাঁচ দফায় বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) দাম মোট ৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত জনগণকে ‘হজম’ করাতে সক্ষম হয়েছিল।
কিন্তু সরকার সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। সে ইচ্ছাও তার ছিল না। জনগণকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে ভাঁওতা দেওয়ার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি লুটেরা ধনিক শ্রেণিকে জ্বালানি খাত থেকে বেপরোয়া লুটপাটের ব্যবস্থা করে দেওয়াই ছিল তার আসল ইচ্ছা ও পরিকল্পনা। তাই ২০১৪ সাল পার হওয়ার পরও এই লুটপাট অব্যাহত রাখার জন্য প্রতিবছর জ্বালানির দাম দফায় দফায় ও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ানো হয়েছে। যখন-তখন যেন জ্বালানির দাম বাড়ানো যায়, সরকার এখন সে জন্য আইন সংশোধনের পাঁয়তারা করছে।
জ্বালানির দাম বাড়ানোর সময় প্রত্যেকবারই ক্ষমতাসীনরা এ কথা বলে থাকে যে, জ্বালানি উৎপাদন খরচ অথবা আমদানি খরচ বাড়ার কারণেই জ্বালানির দামও বাড়াতে হয়েছে। কিন্তু এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে তার যথার্থতা নেই। খরচ বেড়েছে বলে যে হিসাব হাজির করা হচ্ছে তাকে অবধারিত, অপরিহার্য ও যৌক্তিক বলে গণ্য করা যায় না। প্রধানত, দুর্নীতি, ভুলনীতি ও লুটপাটের অর্থ জোগান দেওয়ার কারণে ‘খরচ’ বেড়েছে। এসবের মধ্যে একটি হলো রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের পদক্ষেপ। এ পদক্ষেপ দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি যতটুকু না সম্ভব হয়েছে, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি হয়েছে লুটপাটের সুযোগ। অথচ এর চেয়ে অনেক কম ব্যয়ে বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিল। সে বিকল্প পথ সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা সত্ত্বেও সরকার তা গ্রহণ করেনি। সরকার ‘লুটপাটের’ পথ গ্রহণ করার কারণে যে ‘খরচ’ বেড়েছে তার দায় জনগণ বহন করতে বাধ্য নয়। ‘খরচ বাড়া’র প্রকৃত কারণ সম্পর্কে মাত্র কয়েকটির বিষয় এখানে এখন তুলে ধরছি।
এক. এ কথা সর্বজনজ্ঞাত যে, অনেক ‘রেন্টাল’ ও ‘কুইক রেন্টাল’ বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও অথবা সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন করেও পূর্ণ পরিমাণ উৎপাদনের হিসাব অনুসারে রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন সুবিধাদি ও বিল আদায় করে থাকে। অনেক প্ল্যান্ট অতিরিক্ত তেল ব্যবহারের হিসাব দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ‘তেল-সাবসিডির সুবিধা’ নেয়। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো কাজে সে তেল ব্যবহৃত হয় না। এই লুটপাটের কারণে ‘খরচ’ বেশি দেখিয়ে অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের পকেট কেটে এই ‘বাড়তি খরচ’ আদায় করে নেওয়া হয়।
দুই. বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এ দেশেও তার দাম বাড়াতে হয়েছে বলে যুক্তি দেখানো হয়। এ অজুহাতও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ তাই যদি হতো, তা হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমলে আমাদের দেশেও একই সঙ্গে তার দাম তখন কমত। কিন্তু তা কখনই হয় না। যেমন কিনা বর্তমানে বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১-৩ শতাংশেরও কমে নেমে আসা সত্ত্বেও এ দেশে গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম এক পয়সাও কমানো হয়নি।
তিন. সরকার তার দাম বাড়ানোর পদক্ষেপগুলোকে ‘মূল্যবৃদ্ধি’ না বলে জনগণকে ভাঁওতা দেওয়ার জন্য সেগুলোকে ‘মূল্য সমন্বয়ের’ পদক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করে থাকে। বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে ‘মূল্য সমন্বয়ের’ কথা বলে তারা গ্যাসের দাম বাড়ায়, গ্যাসের দামের সঙ্গে ‘মূল্য সমন্বয়ের’ কথা বলে বিদ্যুতের দাম বাড়ায়, আন্তর্জাতিক অথবা প্রতিবেশী দেশের দামের সঙ্গে ‘মূল্য সমন্বয়ের’ কথা বলে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়ায়। ‘সমন্বয়’ করার কথা বলে তারা কেবল দাম বাড়াতেই থাকে। কোনোদিন তা কমায় না। বিশ্ববাজারে বা প্রতিবেশী দেশে দাম কমলেও তার সঙ্গে ‘মূল্য সমন্বয়’ করার জন্য এ দেশে দাম কমানো হয় না।
চার. বিইআরসি সাধারণ মানুষকে ‘বুঝ দেওয়া’র জন্য বিভিন্ন বিষয়ে কাল্পনিক লক্ষ্যমাত্রা হাজির করে থাকে। সেই অনুসারে ‘কোম্পানি’গুলোর সঙ্গে চুক্তি হয়। কিন্তু প্রকৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় এ ক্ষেত্রে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। আবার গ্যাস সরবরাহে স্বল্পতার কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিদ্যমান ক্ষমতাও অব্যবহৃত থেকে যায়। অর্থাৎ প্ল্যান্টগুলোর পূর্ণ ক্যাপাসিটি ব্যবহৃত হয় না। অথচ চুক্তির শর্ত মেনে প্ল্যান্টের পূর্ণ ক্যাপাসিটির হিসাব অনুসারে খরচ বহন করতে হয়। এই বাড়তি খরচ ‘মূল্যবৃদ্ধি’র দ্বারা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
পাঁচ পিডিবিকে চুক্তি অনুযায়ী ভাড়াভিত্তিক (‘রেন্টাল’ বা ‘কুইক রেন্টাল’) প্ল্যান্ট থেকে পূর্বনির্ধারিত দামে বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যুৎ কিনতে হয়। গ্যাসের অভাবে পিডিবির নিজস্ব প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার সে করতে পারে না। তা করতে না পারায় পিডিবিকে ভাড়াভিত্তিক ‘রেন্টাল’ বা ‘কুইক রেন্টাল’ প্ল্যান্ট থেকে চুক্তির শর্তানুসারে নির্ধারিত কয়েক গুণ বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হয়। অথচ আগে অন্যকে গ্যাস না দিয়ে সে যদি তা নিজে ব্যবহার করতে পারত, তা হলে এই দামের মাত্র ১৫ শতাংশ খরচে সে নিজেই তার চাহিদার সবটুকু পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারত। এর ফলে কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ মূল্য সাশ্রয় হতো। পিডিপিকে তা হলে আর ‘রেন্টাল’ বা ‘কুইক রেন্টাল’ প্ল্যান্টের বিদ্যুতের জন্য যে বাড়তি খরচ এখন করতে হচ্ছে, তা করতে হতো না।
ছয়. বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত তরল জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রেও চলছে সীমাহীন লুটপাট। তরল জ্বালানির ক্রয় মূল্য, জাহাজ ভাড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে রয়েছে অস্বচ্ছতা। চলছে বিপুল মাত্রার দুর্নীতি। এভাবে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচের হিসাব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে তার সবটা দায় ভোক্তাদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সাত. দেশে ‘গ্যাসের উৎপাদন-বৃদ্ধির হারের’ তুলনায় সরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্টগুলোয় ‘গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির হার’ অনেক কম। ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্ষুদ্র আইপিপি ক্যাপটিভ বিদ্যুতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পিডিবির জন্য গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে না। ফলে সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ থাকলেও কেবল গ্যাসের অভাবে তা করা সম্ভব হচ্ছে না। এই সুযোগে ‘রেন্টাল’ বা ‘কুইক রেন্টাল’ প্ল্যান্টের নামে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো বেপরোয়া লুটপাটের সুযোগ করে নিচ্ছে। সরকারের এই গণবিরোধী নীতির আর্থিক বোঝা জনগণের কাঁধে এসে পড়ছে।
আট. বর্তমানে ব্যক্তিমালিকানাধীন ‘রেন্টাল’ ও ‘কুইক রেন্টাল’ প্ল্যান্টকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা স্বার্থান্বেষী শক্তি দেশের জ্বালানি সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। এই ‘লুটেরা মহলের’ স্বার্থে সরকার বিনা টেন্ডারে প্রাইভেট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করার ব্যবস্থা করেছে। এ নিয়ে কোনো আইনি সমস্যা যেন না হতে পারে সে জন্য সরকার ‘বিশেষ দায়মুক্তির আইন’ পাস করে নিয়েছে। তাদের উদারভাবে সরকারি জমি দেওয়া হয়েছে। ভর্তুকি দিয়ে অল্প দামে চড়া মূল্যের তরল জ্বালানি সরবরাহ করা হয়েছে। এসবের ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বিপুলভাবে বেড়ে গেছে। এই বাড়তি ‘খরচের’ সম্পূর্ণ বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ভোক্তাদের কাঁধে।
নয়. এসব দুষ্কর্ম শুরুর সময় সরকার বলেছিল যে, শুধু অসহনীয় লোডশেডিং থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, মাত্র দু-চার বছরের সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে ‘রেন্টাল’ ও ‘কুইক রেন্টাল’ প্ল্যান্ট স্থাপন করতে দেওয়া হচ্ছে। এটি হলো মূল চিকিৎসা শুরুর আগে রোগীকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখার জন্য ‘কোরামিন’ প্রদানের মতো একটি ব্যবস্থা। ২০১৩-১৪ সাল থেকে বিদ্যুতের বিক্রয় মূল্য কমানো শুরু করা সম্ভব হবে। তখন ‘রেন্টাল’ ও ‘কুইক রেন্টাল’ প্ল্যান্টগুলোর সঙ্গে চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু এসব কিছুই করা হয়নি। তবে কোম্পানিগুলোর জন্য ‘লুটপাটের’ সুযোগ ষোলো আনা বহাল রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে সেগুলোকে বছর বছর নবায়ন করা হয়েছে। রোগীকে ‘কোরামিনের’ ডোজ দেওয়া শেষ হচ্ছে না। অথচ আসল চিকিৎসা শুরুর কোনো নামগন্ধ নেই। অবাধ লুটপাটের স্বার্থে এই ব্যবস্থাকে তারা ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁসের’ মতো জিইয়ে রাখতে তৎপর রয়েছে। এ বিষয়ে আরও অনেক এ ধরনের তথ্য তুলে ধরা যায়।
মানুষের ‘করোনা’জনিত চরম দুর্গতির সুযোগে লুটেরাদের ‘শোষণ-চরিত্র’ বন্ধ বা স্তিমিত হওয়ার বদলে তা আরও বেড়েছে। এই লুটেরা চক্র আজ সরকারে, রাজনৈতিক দলে, আমলাতন্ত্রে, ব্যবসায়ী মহলে, ‘সুশীল সমাজে’Ñ সবখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে।
বর্তমান ‘করোনা দুর্যোগের’ সময় ‘লুটপাট’ বন্ধ রাখা বা তা সহনীয় মাত্রায় রাখা হতো স্বাভাবিক মানবিক বিবেচনাপ্রসূত কাজ। কিন্তু লুটেরা-শোষকরা তা করছে না। তার বদলে তারা বরং জনগণের দুর্ভোগ ও অসহায়ত্বের সুযোগে মানুষের দুর্গতির বোঝা আরও বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের লুটপাটের মাত্রা বৃদ্ধি করছে। ‘করোনা’র কারণে দেশের মানুষ যখন তাদের জীবন-জীবিকার অস্তিত্ব নিয়ে দিশেহারা, মানুষ যখন মরব কি বাঁচব তা নিয়ে শঙ্কায়, সে রকম পরিস্থিতিতেও যে ‘লুটেরা-শোষকরা’ তাদের দানবীয় ‘লুণ্ঠন-চরিত্র’ বিন্দুমাত্র বদল করে না, সে কথা এই ‘করোনা মহামারী’র মহাদুর্যোগের সময়েও প্রমাণিত হচ্ছে।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
Leave a Reply